ইসলাম

কুরআন খতম করার ফজিলত। কুরআন খতম করার নিয়ম মাওলানা শরিফ আহমাদ

কুরআন খতম করার ফজিলত । কুরআন খতমের নিয়

 

 

সম্মানিত দ্বীনি ভাই ও বোন । মহাগ্রন্থ আল কুরআনুল কারীম হলো আসমানী সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। এই কোরআন পাঠ সবার জন্য জরুরী। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ পবিত্র কুরআন পড়ে না । খতম করে না । তাই আজ আপনাদের জানাবো পবিত্র কোরআন খতম করা সংক্রান্ত আয়াত ও হাদীস । এবং এ সংক্রান্ত আরো অন্যান্য তথ্য । অতএব পুরো লেখাটি পড়ুন ।

 

কুরআন শব্দের অর্থ কি

 

আল-কুরআন একটি আরবী শব্দ । যা করয়ুন (قرأ) এবং করনুন (قرن)শব্দ থেকে উৎপন্ন । যদি করয়ুন (قرأ) শব্দ থেকে ধরা হয় তাহলে তার অর্থ হবে অধিক পঠিত, যাকে পাঠ করা হয়েছে । আবার যদি করনুন (قرن) শব্দ থেকে ধরা হয় তাহলে অর্থ হবে মিলিত, সংযুক্ত ,সম্পৃক্ত ইত্যাদি ।

 

 

যেহেতু কুরআনের একটি অক্ষর আরেকটি অক্ষরের সাথে, একটি শব্দ আরেকটি শব্দের সাথে ,একটি আয়াত আরেকটি আয়াতের সাথে এবং একটি সূরা আরেকটি সুরার সাথে ছন্দের মত মিল থাকে তাই কোরআনকে القرأن হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় ।

 

কুরআন কাকে বলে ?

 

মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মানবজাতির হেদায়াতের জন্য হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অবতীর্ণ ২৩ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে যে বিধান নাযিল হয়েছে তার সমষ্টি আল কুরআন ।

 

 

আল কুরআন কি ও কেন ?

 

আল-কোরআন কি ? এ প্রশ্নের উত্তর আল-কোরআন নিজেই প্রদান করেছে-

الٓـمّٓ ۚ- ذٰلِکَ الۡکِتٰبُ لَا رَیۡبَ ۚۖۛ  فِیۡہِ ۚۛ  ہُدًی لِّلۡمُتَّقِیۡنَ ۙ

 

অনুবাদঃ আলিফ লাম মীম। এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেযগারদের জন্য । (আল বাকারা ১- ২)

কুরআন খতমের ফজিলত

وَہٰذَا کِتٰبٌ اَنۡزَلۡنٰہُ مُبٰرَکٌ فَاتَّبِعُوۡہُ وَاتَّقُوۡا لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ ۙ

 

অনুবাদঃ এটি এমন একটি গ্রন্থ, যা আমি অবতীর্ণ করেছি, খুব মঙ্গলময়, অতএব, এর অনুসরণ কর এবং ভয় কর-যাতে তোমরা করুণাপ্রাপ্ত হও। (আল আনআম – ১৫৫)

 

আল কুরআন পড়া ফরজ

 

اِقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّکَ الَّذِیۡ خَلَقَ ۚ

 

অনুবাদঃ পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন । (আল আলাক – ১)

 

وَلَقَدۡ یَسَّرۡنَا الۡقُرۡاٰنَ لِلذِّکۡرِ فَہَلۡ مِنۡ مُّدَّکِرٍ

 

অনুবাদঃ আমি কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি বোঝার জন্যে। অতএব, কোন চিন্তাশীল আছে কি?(আল ক্বামার – ১৭)

 

 

রমজান ও কুরআনের সম্পর্ক

 

 

রোজা এবং রমজান মাসে সঙ্গে কোরআনে গভীর সম্পর্ক রয়েছে । এ প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

شَہۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡہِ الۡقُرۡاٰنُ ہُدًی لِّلنَّاسِ وَبَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡہُدٰی وَالۡفُرۡقَانِ ۚ فَمَنۡ شَہِدَ مِنۡکُمُ الشَّہۡرَ فَلۡیَصُمۡہُ ؕ وَمَنۡ کَانَ مَرِیۡضًا اَوۡ عَلٰی سَفَرٍ فَعِدَّۃٌ مِّنۡ اَیَّامٍ اُخَرَ ؕ یُرِیۡدُ اللّٰہُ بِکُمُ الۡیُسۡرَ وَلَا یُرِیۡدُ بِکُمُ الۡعُسۡرَ ۫ وَلِتُکۡمِلُوا الۡعِدَّۃَ وَلِتُکَبِّرُوا اللّٰہَ عَلٰی مَا ہَدٰىکُمۡ وَلَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ

 

অনুবাদ: রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।

কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তাআলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর। (আল বাকারা – ১৮৫)

উক্ত আয়াতের প্রথমাংশে রমজানের গুরুত্ব ও মহত্ত্বের কথা স্পষ্ট ।‌ অর্থাৎ রমজানের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম কারণ হলো‌ এ মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে ।

 

কুরআন কেন পাঠ করবেন ?

 

রমজান মাসের অর্থ সম্মান ও মর্যাদা কেন ? নুজুলে কুরআনের সাথে রমজানের সম্পর্ক রয়েছে তাই রমজানের এতো ফজিলত। এতো দাম । সুতরাং এর দ্বারা বুঝা যায় যার সাথে কোরআনের সম্পর্ক যত বেশি হবে তার মর্তবা ও মর্যাদা তত বেশি হবে ।

তাই সে ফেরেশতা হোক, নবী-রাসূল হোক, বা কোন স্থান, কোন সময় কিংবা কোন ব্যক্তি হোক, বস্তু হোক যাই হোক না কেন ! কোরআনের সাথে যার যত বেশি সম্পর্ক হবে তার মর্যাদা ততো বেশি বৃদ্ধি পাবে ।

 

 

ফেরেশতাদের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ায় ফেরেশতা জিবরাঈল আলাইহিস সালাম সমস্ত ফেরেশতা দের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন । নবীর সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ায় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত নবী-রাসূলগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছেন । শহরের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ায় শহর মক্কা-মদিনা পৃথিবীর সমস্ত শহর থেকে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছেন। যার কারণে শহর দুটির নাম নেওয়ার সময় অত্যন্ত সম্মানের সাথে বলা হয় মক্কাতুল মুকাররমাহ ও‌ মদিনাতুল মুনাওয়ারা ।

মাসের সাথে সম্পর্ক হওয়ায় এ মাস ১২ মাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাস হয়েছে । সুতরাং যে ব্যক্তি সঙ্গে কোরআনের সম্পর্ক হবে, যে এই কোরআন মুখস্ত করবে ,তেলাওয়াত করবে, এর বিধি বিধান মোতাবেক আমল করবে ,কেয়ামতের ময়দানে তার মর্যাদা ও সকলের উপরে হবে ।

এ কারণেই রমজান মাসে কোরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব দিতেন স্বয়ং নবীজি । হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সবচেয়ে বেশি দানশীল ও বদান্যতা । রমজানে তার দানশীলতা ও বদান্যতা অনেক বেড়ে যেত ।

 

কুরআন খতমের ফজিলত

 

পবিত্র কুরআন বুঝে পড়ুন অথবা না বুঝে পড়ুন । পাঠ করলেই সওয়াব পাবেন । এজন্য নবীজি পবিত্র কুরআন পড়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে বলেছেন,

যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ ( অক্ষর) পাঠ করল সে একটি নেকী লাভ করল এবং একটি নেকি দশটি নেকীর সমতুল্য হবে । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন আমি এটা বলি না যে ألم একটি হরফ বরং الف একটি হরফ لام একটি হরফ ও م একটি হরফ । ( সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং ২৯১০, মিশকাত- ২১৩৭).

 

অর্থাৎ আলিফ-লাম-মীম তিনটি হরফের সমন্বয়ে একটি শব্দ ।‌এই একটি শব্দও পাঠ করা মাত্র ৩০ নেকি পাওয়া যাবে । আর রমজান মাসে প্রত্যেক আমলের সওয়াব ৭০ গুণ বৃদ্ধি পায় । তাহলে এবার হিসেব করে দেখুন পবিত্র কুরআনের সকল সূরার সকল আয়াত পড়লে কত সওয়াব হতে পারে ! আর খতমের মাধ্যমে তো সওয়াবের পাহাড় অর্জন করা যাবে একথা সহজেই বোঝা যায় ।‌

 

কুরআন পাঠ সংক্রান্ত হাদীস

 

১ নং হাদীস

 

আসির ইবনে জাবির রদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন আল কুরআন পড়া হচ্ছে সর্বোত্তম ইবাদত । (জামেউস সগীর, সহীহ বুখারী )

 

২ নং হাদীস

হযরত আবু উমামা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি । তিনি বলেন তোমরা আল কুরআন পাঠ করো । নিশ্চয় তা কেয়ামত দিবসে তার সাথীদের জন্য সুপারিশ করতে উপস্থিত হবে । ( সহীহ মুসলিম ,হাদীস নং ৮২৪)

 

৩ নং হাদীস

 

হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহা থেকে বর্ণিত । আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন আল কুরআনের জ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তি ওইসব ফেরেশতাদের শ্রেণীভূক্ত যারা মহা পূণ্যবান এবং লেখার কাজে লিপ্ত আর যে ব্যক্তি অতিকষ্টে ঠেকে ঠেকে আল কোরআন পড়ে সে দিন সওয়াব পাবে । ( সহীহ বুখারী ও মুসলিম )

 

৪ নং হাদীস

 

প্রত্যেক রমজানে ফেরেশতা জিব্রাইল আলাইহিস সাল্লাম তার সঙ্গে মিলিত হতেন এবং পুরো কোরআন একে অপরকে শোনাতেন । (সহীহ বুখারী , হাদীস নং ৬)

 

তারাবীতে কুরআন খতম

তারাবিতে কুরআন খতম

পবিত্র কুরআনুল কারীম প্রতি মাসে এক খতম করা উচিত। তবে সাত দিনে খতম করা সবচেয়ে উত্তম । আর এক খতম করতে গিয়ে ৪০ দিনের বেশি সময় লাগানো উচিত নয় । হাদীসে এসেছে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোরআনুল কারীম খতম করতে ৪০ দিনের বেশি লাগালো সে অনেক দেরী করে ফেলল । তাই রোজার মাসে গুরুত্ব দিয়ে রুটিন করে কুরআন পড়া উচিত । যেন অনেকগুলো খতম করা সম্ভব হয়।

কুরআন খতম করার ফজিলত

যদি তারাবীর মধ্যে কোরআন খতমের সওয়াব নিতে চান তাহলে সেক্ষেত্রে এই হাদীসটি স্মরণযোগ্য । হযরত আবু যর গিফারী রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বর্ণনা করেন । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ইমামের সঙ্গে তারাবীহ নামাজ পড়লো, ইমাম প্রস্থান করা পর্যন্ত ( জামাতে নামাজ সমাপ্ত করে গেল ) তার কিয়ামুল লাইল (রাত জাগরণের পূর্ণ সওয়াব ) লিখিত হবে ।

 

 

কুরআন খতম করার নিয়ম

 

হযরত উসমান রাদিআল্লাহু আনহু, হযরত উবাই ইবনে কাব রাদিআল্লাহু প্রমুখ সাহাবী প্রতিদিন যত টুকু তেলাওয়াত করতেন তা মঞ্জিল নামে পরিচিত । তাই কোরআন ৭ মঞ্জিলে বিভাজিত হয়েছে । পরবর্তী সময়ে এক মাসে খতম সম্পন্ন করার জন্য কোরআনুল কারীমকে সমান ৩০ ভাগে বিভক্ত করা হয় । যা পারা নামে পরিচিত ।

এরপর আরো সহজ করার জন্য প্রতিটি পারা কে সমান দুই ভাগে ভাগ করা হয় হয়েছে । এর প্রতিটি অংশকে নিসফ বলা হয় । অর্থাৎ এর অর্থ হল অর্ধেক । প্রতিদিন এতটুকু পরিমান তেলাওয়াত করলে প্রতি দুই মাসে এক খতম হয় । এভাবে এক-তৃতীয়াংশ দুই-তৃতীয়াংশ প্রতিদিন এই পরিমাণ পড়লেও প্রতি তিন মাসে একবার খতম হবে । সর্বশেষ আসে এক চতুর্থাংশ যদি কেউ প্রতিদিন এইটুকু তেলাওয়াত করেন তাহলেও প্রতি চার মাসে তার এক খতম হবে ।

 

পড়ুন – যাকাত দেওয়ার নিয়ম 

 

দুটি কথা

 

শেষ পর্যায়ে এসে দুটি কথা বলবো আপনাদের । প্রথম কথাটি হলো জীবন ঘনিষ্ঠ যেকোন প্রশ্ন উত্তর জানতে কমেন্ট করতে পারেন । দ্রুত জবাব দেওয়া হবে ইনশাআল্লাহ । আর দ্বিতীয় কথাটি হলো তারাবীহ সহ সকল প্রকার নামাযে তাজবীদের সাথে তিলাওয়াত করুন । এটা খুব জরুরী । তাজবীদ বিহীন অস্পষ্ট অতি দ্রুত তিলাওয়াত শরীআতে নিষেধ। (সূরায়ে মুযযাম্মিল ৪ তাফসীরে মাজহারী পৃঃ৯/১০ )

নামাজের বাইরে ও পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে সুন্দর ও স্পষ্ট আওয়াজে পড়া উচিত ।‌ এ ক্ষেত্রে হাদীসটি স্মরণ রাখবেন ‌।

হযরত বারা ইবনে আযেব রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু‌ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন সুমধুর কন্ঠে আল কোরআন তেলাওয়াত করো । ( ইবনে মাজাহ হাদীস নং ১৩৪২ আবু দাউদ হাদীস নং ১৩২০)

 

 

 

লিখেছেনঃ মাওলানা শরীফ আহমদ

 

 

Related Articles