ফেসবুক আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় শরিফ আহমাদ
ফেসবুক আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়
সুপ্রিয় পাঠক পাঠিকা । ফেসবুকের নাম শুনেনি এমন মানুষ পাওয়া কঠিন । ছোট বড় সবাই জানে ফেসবুকের নাম । ব্যবহার ও করে শহর গ্রামের কমবেশি সবাই । তাই ফেবুর পরিচয় বলা এখন নিষ্প্রয়োজন ।
আলোচনার সুবিধার্থে পুরনো দুটি তথ্য নতুন করে উল্লেখ করা যেতে পারে । ফেসবুক মূলত মেটা প্ল্যাটফর্মসের মালিকানাধীন বিশ্ব সামাজিক আন্তঃ যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রধান একটি ওয়েবসাইট । যা ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় । বিনামূল্যে সদস্য হয়ে এখান থেকে প্রায় সমস্ত জরুরী কাজ সম্পাদন করা যায় ।
৩১ জুন ২০২০ এর হিসাব অনুযায়ী সারা বিশ্বের ২.৭০ মিলিয়ন মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে থাকে ।
ফেসবুককে আরও আকর্ষণীয় এবং জনপ্রিয় করে তুলতে কর্তৃপক্ষ আরো নতুন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। এমন খবর মিডিয়াতে এসেছে ।
প্রত্যেকটি জিনিসের নেগেটিভ এবং পজেটিভ দিক থাকে । তদ্রূপভাবে ফেসবুকের ও ভালো এবং মন্দ দিক রয়েছে । তবে ভালোর চেয়ে ফেসবুক এখন নেশার মত আসক্তিতে পরিণত হয়েছে । এই ফেসবুক আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় নিচে বিস্তারিত লেখা হলো ।
সূচিপত্র
ফেসবুক ব্যবহারের উপকার :
বর্তমানে ইলেকট্রিক এবং প্রিন্ট মিডিয়াগুলো দালালের ভূমিকার পরিণত হয়েছে । গুরুত্বপূর্ণ নিউজ প্রকাশ করে না । দেশ ও বিশ্বের প্রকৃত অবস্থা জানায় না । কিন্তু ফেসবুকে প্রকৃত অবস্থা সহজে জানা যায় । উপলব্ধি করা যায় অনেক কিছু । এদিক থেকে একজন সচেতন নাগরিক ফেসবুক ব্যবহারে উপকৃত হয় । শিক্ষামূলক ভিডিও ও তথ্যবহুল বিভিন্ন কনটেন্ট জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করে । যা কোন স্কুল-কলেজের পাঠ্য বই দিতে পারে না । কার কোন আত্মীয়-স্বজন ওপারে চলে গেল,কে নতুন করে এলো পৃথিবীতে এসব জানা যায়।জানা যায় প্রিয় বন্ধু-বান্ধবরা কার কি উন্নতি হলো ? কে কোথায় কি সংবর্ধনা পেলো ?
ফেসবুক আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়
তাছাড়া অনেক বড় কবি সাহিত্যিকদের সাথে যোগাযোগ করা যায় । ফেসবুক ব্যবহারের ইত্যাদি আরো বেশ কিছু উপকার রয়েছে ।
ফেসবুক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা:
ফেসবুক সামাজিক যোগাযোগের বড় একটি মাধ্যম ।
এটিকে মানুষ কয়েকটি কারণ ব্যবহার করে থাকে ।
১.টাইম পাস করার জন্য ব্যবহার করে থাকে ।
২. শিক্ষনীয় বিষয় জানার জন্য ব্যবহার করে থাকে ।
৩.অনলাইনে ইনকামের জন্য ব্যবহার করে থাকে ।
উল্লেখিত কারণগুলোর মধ্যে আপনার কোনটি প্রয়োজন ? আপনি সেই হিসেবে ফেসবুক ব্যবহার করবেন । ফেসবুক ব্যবহার ছাড়া উল্লেখিত কাজগুলো খুব সহজে করা সম্ভব নয় ।
তাছাড়া এখানে খুব সহজেই একাউন্ট খোলা যায় । ব্যবহারকারিরা ফ্রেন্ডস সংযোজন, জরুরি বার্তা পাঠানো এবং তাদের ব্যক্তিগত তথ্যাবলী আদান-প্রদান করতে পারেন। নিজের শহর, কর্মস্থল, বিদ্যালয় ইত্যাদি ও নেটওয়ার্কে যুক্ত করতে পারেন । প্রয়োজনে সব কিছু লক করে রাখার সুবিধাও আছে । অতএব এ কথা বলাই যায় ফেসবুক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা অধিক ।
ফেসবুক এখন বিরক্তির কারণ
বিশ্বের অনেক দেশে ফেসবুক নিষিদ্ধ । বাংলাদেশে ফেসবুক নিষিদ্ধ না হলেও এখনো অধিকাংশ নারী পুরুষ এটি ব্যবহার করে না । তারা ভালোই আছে । আর যারা ব্যবহার করছে তাদের অ্যাকাউন্ট থাকা সত্ত্বেও অনেকেই বিরক্তির কারণে ব্যবহার করছে না ।
বিরক্তির কারণ অনেক হতে পারে । যেমন:
১. হাতে সময় কম থাকা
২. বিরক্তিকর গ্রুপ থাকা
৩. অশ্লীল বিজ্ঞাপন আসা
৪. গোনাহ থেকে বাঁচা
উল্লেখিত চারটি কারণে অনেকে ফেসবুক ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছে । কেউ কেউ দীর্ঘ বিরতির পর ফিরে এলেও কেউ আসে না। বিরক্তিকর গ্রুপ ও অশ্লীল বিজ্ঞাপন ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বন্ধ করলে তাদের জনপ্রিয়তা আরো বাড়বে বলে অনেকে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
ফেসবুকে কারা আসক্ত ?
বর্তমানে ফেসবুক শহর গ্রামের নারী-পুরুষ ছোট-বড় সবাই ব্যবহার করে থাকে । যেকোনো পেশার যে কোন মানুষ ব্যবহার করে থাকে । তবে তরুণ এবং যুবকরা ফেসবুকে বেশি আসক্ত । এখান থেকে তারা বিভিন্ন অশ্লীল গ্রুপে আড্ডা দেওয়া,মেয়েদের সাথে বিরক্তিকর অর্থহীন চ্যাটিং ইত্যাদি করে।
অফলাইনের মত অনলাইনেও আজ অনেক নারী ইভটিজিং এর শিকার ।
আপনি কি ফেসবুকে আসক্ত ?
ফেসবুক আসক্তির প্রধান কিছু আলামত আছে। নিম্নে দেওয়া হলো । এগুলো থেকে একাধিক আলামত আপনার মধ্যে পাওয়া গেলে বুঝে নিবেন আপনি ফেসবুক নেশায় আসক্ত।
১. সকালে ঘুম থেকে উঠে সর্বপ্রথম মোবাইল হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঘুরে আসা ।
২. অন্তত নোটিফিকেশন এবং কমেন্ট বক্স চেক করা ।
৩. যেকোনো কাজ করার সময় কিছুক্ষণ পর পর ফেসবুকে অনর্থক ঢোকা ।
৪. নোটিফিকেশন সাউন্ড বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে মোবাইল হাতে নেওয়া ।
৫. নিজের সম্পর্কে ফেসবুকে মাত্রাতিরিক্ত পোস্ট করা ।
৬. কোন কমেন্ট বা নোটিফিকেশন দেখলে উত্তেজিত হওয়া ।
৭. রিয়েল জীবনে কারো সাথে কথা বলা , সময় দেওয়ার চেয়ে ফেসবুকে বেশি সময় দেওয়া ।
ফেসবুক আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়
৮. ফেসবুকে কাউকে ফ্রেন্ড বানানোর জন্য অস্বাভাবিক আচরণ করা । বারবার মেসেজ দিয়ে বিরক্ত করা ।
৯. যেকোনো পোস্টকে ফ্রেন্ডদের মাঝে ট্যাগ করা ।
১০. লাইক কমেন্ট বেশি না হলে হতাশ হয়ে পড়া ।
১১.লাইক কমেন্ট বেশি নিয়ে অন্যদের সাথে গর্ব করা ।
১২. ফেসবুক ছাড়া নিজেকে অসহায় এবং ফাঁকা ফাঁকা অনুভব করা ।
১৩. ঘুমানোর আগ মুহূর্তে সামান্য হলেও ফেসবুকে ঘুরে আসা ।
১৪. সামান্য নেট স্লো কিংবা মোবাইলে অন্যান্য প্রবলেম হলে খুব বিরক্ত হওয়া।
১৫. কখন কি স্ট্যাটাস দেয়া যায় তার চিন্তা করা ।
ফেসবুক আসক্তির ক্ষতিসমূহ
ফেসবুক আসক্তি মাদকের মতোই ভয়ংকর ও ভয়াবহ । অতিরিক্ত ফেসবুক নেশা মানুষের অসংখ্য ক্ষতি সাধন করে । আগে থেকে সাবধান না হলে পরে পস্তাতে হবে।
১. মূল্যবান সময় নষ্ট হয় ।
২. টাকায় কেনা এমবির অপচয়।
৩. আসক্ত ব্যক্তির উপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার ।
৪. হতাশা এবং দুশ্চিন্তা প্রবল হওয়া।
৫. কাজে মনোযোগ হারিয়ে ফেলা ।
৬. সকল দায়িত্ব ভুলে অনর্থক চ্যাটিং করা ।
৭. লেখাপড়ায় অনিহা তৈরি হওয়া।
৮. মাথাব্যথা, পিঠব্যথা,ও মেরুদন্ডে সমস্যা হওয়া ।
৯.শারীরিক ওজনে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা ।
১০. চোখের জ্যোতি কমে যাওয়া।
১১. ঘুম কম হয়ে শারীরিক সৌন্দর্য হারিয়ে যাওয়া।
১২. আরো বিভিন্ন প্রবলেম নিজে নিজে উপলব্ধি করা।
ফেসবুক আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়
ফেসবুক আসক্তি থেকে মুক্তির জন্য খুব কঠিন কিছু করতে হবে না । কয়েকটি টিপস মেনে চললেই এই আসক্তি সহজে কমে যাবে ইনশাআল্লাহ । তবে তার আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলি । অনেক বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক কিংবা সিনেমার কথিত তারকারা ফেসবুকে বেশি সময় দেয় না । তাদের কোন বই কিংবা সিনেমা প্রস্তুত হলে তারা সেগুলোর নিউজ আপডেট দেয় ।
এভাবে জনপ্রিয়তা বাড়ায় । এমনকি তারা তাদের কমেন্ট বক্সগুলো পর্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া চেক করে না । আর অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের একাউন্টগুলো অনেক ক্ষেত্রে ্ ফেক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে । কখনো সখনো ফেক না হলে ও অন্যান্য লোক সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করে । এখান থেকেও ফেসবুকে আসক্ত নারী পুরুষের শিক্ষা নেওয়া উচিত । এবার ফেসবুক আসক্তির উপায় গুলো জানুন ।
১. মোবাইল থেকে ফেসবুক অ্যাপটি আনইন্সটল করে দিন। যদি আনইন্সটল করা সম্ভব না হয় তাহলে লক আউট দিয়ে দিন।
২. আজেবাজে গ্রুপ থেকে লিভ নিয়ে নিন ।
মূল্যবান সময় এগুলোর পিছনে বেশি নষ্ট হয় ।
৩. আপনার যদি ল্যাপটপ বা কম্পিউটার থাকে সেখানে ফেসবুক লগইন করুন । তাহলে মোবাইল কিছুটা স্বস্তি পাবে এবং আপনি আসক্তি থেকে দূরে থাকতে পারবেন ।
ফেসবুক আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়
৪. কম্পিউটার বা ল্যাপটপ না থাকলে মোবাইলে থাকা ফেসবুক অ্যাপটির নোটিফিকেশন বন্ধ করে দিন ।
৫. যদি আপনার মোবাইলে মেসেঞ্জার চালু থাকে সেটিকে আনইন্সটল করে দিন । এটা সম্ভব না হলে মেসেঞ্জার নোটিফিকেশন অফ করে দিন ।
৬. ফেসবুক অ্যাপ ছাড়া অন্য ব্রাউজারে লগইন করে রাখুন । তখন অনর্থক কোন নোটিফিকেশন আসবে না । একান্ত প্রয়োজন হলে ঢুকে আবার বের হয়ে আসতে পারবেন ।
৭. ফেসবুক থেকে দূরে থাকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন । এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় । যত টিপস আপনাকে দেওয়া হোক আপনি যদি নিজের থেকে আসক্তি কমানোর নিয়মগুলো ফলো না করেন তাহলে হাজার টিপস দিলেও কোন কাজ হবে না ।
৮. আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন। দোয়ার মাধ্যমে সবকিছুর সহজে সমাধান হয়ে যাবে ।
ফেসবুক আসক্তি কমানোর উপায়
একান্ত প্রয়োজনে আপনি অবশ্যই ফেসবুকে প্রবেশ করতে পারেন । কিন্তু সময়ের প্রতি লক্ষ্য রাখবেন । দ্রুত নিজের কাজ সম্পাদন করে বের হয়ে আসবেন ।
আর ফেসবুক আসক্তি থেকে মুক্তির জন্য অন্য কিছুতে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন । যেমন:
১. আপনি যদি স্টুডেন্ট হয়ে থাকেন তাহলে সিলেবাসের বই পাঠে ব্যস্ত থাকুন ।
২. যদি আপনি স্টুডেন্ট না হয়ে থাকেন তাহলে গল্প উপন্যাস কিংবা ইসলামিক সাহিত্য পাঠ করুন ।
৩. সাংসারিক বিভিন্ন বিষয়ের খোঁজখবর নিন । সমস্যা হলে সমাধানে এগিয়ে যান ।
৪. বন্ধুবান্ধব কিংবা অন্যদের সাথে কিছুটা সময় কাটান ।
৫. প্রতিটি কাজকর্মের হিসাব আল্লাহর কাছে দিতে হবে এই খেয়াল মাথায় রেখে জীবন যাপন করুন । গুনাহ কমে যাবে এবং ফেসবুক আসক্তি থেকে দূরে থাকা সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ । আলোচনার শেষ মুহূর্তে একটা গুরুত্বপূর্ণ হাদীস উল্লেখ করছি।
হযরত আবু বারজা আসলামি রাদিআল্লাহ তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কেয়ামতের দিন বান্দার দুটি পা ততক্ষণ পর্যন্ত নড়াতে পারবে না যতক্ষণ না তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে যে , তোমার জিন্দেগি কোথায় ব্যয় করেছো ? জ্ঞান অনুসারে কি আমল করেছো ? সম্পদ কোথা থেকে উপার্জন করেছো ? আর কিসে খরচ করেছো এবং তোমার শরীরকে কি কাজে নিঃশেষ করেছো ?
( জামে তিরমিজি, সুনানে দারেমী)
লিখেছেন: শরিফ আহমাদ
লেখক ও শিক্ষক
Read Also- সাংবাদিক হওয়ার যোগ্যতা