STORY

ছোটদের শিক্ষামূলক গল্প। নদীর পাড়ে একদিন

ছোটদের শিক্ষামুলক গল্প

নদীর পাড়ে একদিন

 

 

মামার সাথে হাঁটতে হাঁটতে বহুদূর চলে এসেছে ওরা ‌। ওরা মানে সুরাইয়া নওশীন ,সাজিদ সাফিন আর নুহাশ । ওরা চারজন গ্রামের সবুজ পথ,পথের দুপাশের বিভিন্ন গাছ, ফসলের মাঠ ইত্যাদি দেখছে ।

 

তাছাড়া এই রূপালী বিকেলের পরিবেশটাও মনোরম । অন্যরকম এক আবেশ তৈরি করছে দেহ মনে । আর হবেই না কেন ! চারদিকে তো আলো ছায়ার লুকোচুরি আর ঝিরিঝিরি হাওয়ার সংগীত । আরো সামনে হাঁটতে হাঁটতে মামা বললেন,

 

আসর পরে বের হয়েছি

এলাম অনেক পথ

কোথাও গিয়ে বসবো কিনা

জানাও মতামত ।

 

চটপটে সুরাইয়া নওশীন ঝটপটে বলে উঠলো মামা ওই তো , ওই গাছটার নিচে গিয়ে বসি । নুহাস বললো, এই বট গাছটা বেশ পুরনো । অনেক কিছুর সাক্ষী হয়ে আছে আজ সে । ভয়ংকর ভৌতিক অনেক ব্যাপার ও নাকি আছে ওখানে । তাই মামা আমরা আর একটু হেঁটে নদীর ধারে যাই । দূর্বা ঘাসের নরম গদিতে বসে গল্প করি ।

ছোটদের শিক্ষনীয় গল্প

ভৌতিক ব্যাপার কথাটা শুনে মামা মুচকি হাসলেন । মনে মনে ভাবলেন এ বিষয়ে এদের পর্যাপ্ত জ্ঞান দিতে হবে ।‌ আপাতত ওদের পরামর্শে তিনি নদীর ধারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন । আবারও ছড়া কেটে ‌বললেন,

ছোটদের শিক্ষামূলক গল্প

আচ্ছা চলো আমরা সবাই

নদীর ধারে যাই

দুর্বা ঘাসের পিঠে বসে

কোমল হাওয়া খাই ।

 

নদীর কলকল ছুটে যাওয়া আর ঝিরিঝিরি হাওয়ার মাঝে চলছে ওদের আড্ডা । সবার আগে কথা বলে উঠলো সুরাইয়া নওশীন।

আচ্ছা মামা আপনি তো কবি এবং জ্ঞানী মানুষ । আপনি যে ছড়ায় বললেন হাওয়া খাই ,হাওয়া কি খাওয়া যায় ? চুপ করো নওশীন ! চুপ করো । একটু রাগতো স্বরে বললো নুহাশ। মামা ওটা মজা করে বলেছেন ।

ওদের সংক্ষিপ্ত ঝগড়া মিটাতে মামা বললেন , ঢাকা শহরের তীব্র যানজট আর বিষাক্ত ধোয়াতে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় । দম বন্ধ হয়ে আসে যেন । কিন্তু গ্রামের মিষ্টি হাওয়াতে প্রাণ নেচে ওঠে । শরীরে পুলক অনুভূত হয় । মনে হয় হাওয়াগুলো  খপ করে ধরে গপ করে গিলে ফেলি । তাই হাওয়া খাওয়ার কথা বলেছি । আচ্ছা থাক ওসব কথা ।

ছোটদের শিক্ষামূলক গল্প

এখন তোমাদের আমি একটা গল্প শোনাই । তার আগে তোমরা আমাকে বলো তোমাদের লেখাপড়ার খবর কি ? দৈনিক তোমাদের রোজ নামচা লিখতে বলেছিলাম । তোমরা কি নিয়মিত লিখ ?

এতক্ষণ সবার মুখে মিষ্টি কথার ফুল ফুটলেও লেখাপড়া আর রোজ নামচার কথা শুনে সবাই কেমন যেন ভিজা মুড়ির মতো চুপসে গেল ।‌ তাই মামা পরিবেশটা সুন্দর করতে কলরবের বিখ্যাত ঐ গানটা ধরলেন ,

ইকরা ইকরা পড়ো, ইকরা ইকরা….

ইকরা ইকরা পড়ো, ইকরা ইকরা….

জ্ঞানী হলে ইকরা, জানতে হলে ইকরা ।

 

ভাংগা ভাংগা গলায় তিনি ভালোই গাইলেন। ওরাও সুর মিলিয়েছে থেকে কিছুটা। এবার অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এলো ওরা । ওদের গান আড্ডা দেখে আরো কজন‌ ছেলে এলো । যোগ দিলো খেলাধুলা ফেলে। মামা ওদের কুশল বিনিময় করে সবাইকে উদ্দেশ্য করে খুব কৌশলে পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি গল্প কবিতা, ইসলামিক বই পড়ার গুরুত্ব বুঝালেন । অন্য সময়ের মত লেখালেখির তাগাদা ও দিলেন ।

পড়ুন – ছোটদের সাধারণ জ্ঞান 

সাজিদ সাফিন বলল মামা , আপনি সাহিত্য চর্চা করেন । অনেক কিছু লিখতে পারেন । বড় বড় কবি সাহিত্যিকরা প্রায় সব বিষয় লিখে গেছে । কিন্তু আমরা তো ছোট মানুষ আমরা কি বিষয়ে লিখবো ? ওদের মত কি পারব ?

তুমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন করেছো। বললেন মামা ।

কবি সাহিত্যিকগণ লিখে গেছেন তাদের মত করে আর তোমরা লিখবে তোমাদের মত করে । আর নিয়মিত চর্চা করে গেলে অবশ্যই ওদের চেয়ে ভালো করতে পারবে তোমরা ।

শোনো তোমাদের একটা আলাদা টিপস দিই । বড় একজন কবি ছিলেন মহিউদ্দিন আকবর দাদুমনি রহ: । তিনি অনেকগুলো বই লিখেছেন । অনেক সাহিত্য আসরে তিনি আসতেন। বিভিন্ন জ্ঞান গর্ব কথায় আমাদেরকে অনেক অনুপ্রাণিত করতেন ।

 

ছোটদের শিক্ষামূলক গল্প

তার অনেক কথা এখনো কানে বাজে। স্মৃতির ডায়েরী থেকে তার দু একটি কথা তোমাদের শোনাচ্ছি – ফুল ফল ,গাছপালা, নদী প্রকৃতি এগুলো নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে । তোমরাও লিখবে । এগুলো লিখে হাত পাকা করবে । তারপরে লিখবে ইসলাম নিয়ে । দু হাতে লিখবে আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে । প্রকৃতি নিয়ে লেখার মানুষ বহুত আছে কিন্তু ইসলাম নিয়ে লেখার মানুষ কম । সত্যের পক্ষে কলম ধরার মানুষ অল্প।

 

তিনি আরো বলতেন, লেখার সময় ডান পাশে কাজী নজরুল ইসলাম এবং বাম পাশে কবি ফররুখ আহমদকে রাখবে । মাঝখানে বসে এবার তুমি দুজনের চেয়ে ভালো লেখার চেষ্টা করবে । মনে করবে তারা তোমার সাথে আছেন । পাশেই আছেন । দেখবে অনেক ভালো লেখা চলে আসবে ।

আর হ্যাঁ লেখা শুরু করলে দেখবে হাজার হাজার থিম মাথায় আসবে । অতো লেখার সময়ই পাবে না । একান্ত যদি মাথায় না আসে তাহলে তোমরা বিখ্যাত ঐ খরগোশ ও কচ্ছপ গল্পের দ্বিতীয় পাঠ লিখতে পারো ।‌ জনপ্রিয় উপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ নবীজি লেখা শুরু করেছিলেন । শেষ করার আগে তার ইন্তেকাল হয়েছে । তোমরা চাইলে সেই বইয়ের পরবর্তী অংশ থেকে লেখা শুরু করতে পারো । এমন আরো অনেক গল্পের বইয়ের আগে-পরে থেকে শুরু করে নতুন বই লেখা যায় । তবে একটা কথা মনে রাখবে যদি ছড়া কবিতা লিখ তাহলে যেন আল মাহমুদের চেয়ে উত্তীর্ণ হয় । আর কবিতার ক্ষেত্রে সিরাজাম মুনীরার মতো উৎকৃষ্ট কবিতা হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবে । স্মরণ রাখবে এ যুগেও আর রাহীকুল মাখতুম লিখে‌ আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করার লোক আছে । অতএব তোমরা সীরাত লেখা শুরু করো। ইনশাআল্লাহ সফলতা আসবেই ।

 

এবার সাজিদ সাফিন ,সুরাইয়া নওশীন এবং নুহাশ একসঙ্গে বলে উঠলো হুমম মামা ! আমরা মোটামুটি বুঝতে পেরেছি ।

এবার একটা গল্প বলো। আবদার ঝরে পড়ল মিষ্টি মেয়ে নওশীনের কন্ঠে ।

মামা গল্প বলা শুরু করার আগ মুহূর্তে হঠাৎ করে নুহাশ একটি প্রশ্ন করল । নবীজির পথে কাঁটা বিছানো বুড়ির গল্পটা তোমার কি মনে আছে মামা ?

মামাতো অবশ্যই গল্পটা জানেন । এটা সবার শোনা প্রসিদ্ধ একটি গল্প ।‌ তিনি নিজে গল্পটা না বলে তার প্রিয় ভাগনা-ভাগ্নিদের উৎসাহ দিতে ছড়ায় ছড়ায় বললেন ,

ছোটদের শিক্ষামূলক গল্প

তোমার থেকে প্রশ্ন এলো

তুমি শোনাও গল্প

আমরা সবাই শুনবো সবাই

সময় নিবে অল্প ।

 

নুহাশ বলল আমাদের স্কুলের স্যার এ গল্পটা শুনিয়েছেন । কিন্তু হঠাৎ করে একদিন ইউটিউবে এক বক্তার ওয়াজে শুনলাম এ গল্পটা নাকি ভিত্তিহীন । বানোয়াট । ঐ বক্তার কথা সত্য কিনা সেটা তুমি পরে আমাদের নিশ্চিত হয়ে বলবে । তবে আমি এই ফাঁকে গল্পটা একটু বলি। এই বলে সে সংক্ষেপে গল্প বলা শুরু করল:

মক্কা শহরে ছিল এক বুড়ি । সে ছিল ভারী দুষ্টু । সে নবীজির পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত । নবীজিকে কষ্ট দেওয়ার জন্য । হঠাৎ একদিনে ঘটলো ভিন্ন ঘটনা। পথে কোন কাঁটা নেই । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুড়িকে দেখতে না পেয়ে তিনি বুড়ির বাড়িতে গেলেন । দেখতে পেলেন বুড়ি অসুখে কাতর । প্রচণ্ড জ্বরে আবোল তাবোল বকছে । তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চরম শত্রু বুড়ির বিপদে সেবার হাত সম্প্রসারিত করে দিলেন ।

বস্তুত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যবহারিক জীবনে এমন মানব সেবার দৃষ্টান্ত অসংখ্য ।

 

চোখে মুখে যেন গল্প শেষ করলো ও । তখন মামা বললেন, তুমি ঠিকই বলেছো নুহাশ । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনে মানব সেবার অসংখ্য নজির বিদ্যমান । তুমি প্রথমেই এই গল্পটির সত্যতা নিয়ে জানতে চেয়েছিল । তোমাকে ছোট করে বলি। এই গল্পটি কোন কোন তাফসীরের কিতাবে উল্লেখ করা হলেও কোন সহীহ হাদীসে এই বর্ণনা পাওয়া যায় না । অথচ সহীহ সনদে বর্ণিত শিক্ষামূলক নবীজির আরো অসংখ্য ঘটনা আছে । সেগুলো প্রচার করা উচিত । নবীজির দয়া, মায়া-মমতা বোঝানোর জন্য ভিত্তিহীন বর্ণনার কোন প্রয়োজন নেই । কেননা নবীজির শানে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন ,

আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি।(আল আম্বিয়া – ১০৭)

সুরাইয়া নওশীন বললো,মামা অতো ভারী কথা আমার বুঝতে কষ্ট হয়। তুমি এবার গল্প বলো । আমরা গল্প পাগল । সন্ধ্যা হয়ে আসছে প্রায় ।‌ তার কথায় বাইরে থেকে আসা কজন‌ ছেলেও সায় দিলো ।

ছোটদের শিক্ষামূলক গল্প

 

তার কথায় তিনি ঘটির দিকে তাকিয়ে দেখেন প্রায় মাগরিবের সময় হয়ে এসেছে । একটু পরে হবে আজান । তাই তিনি বললেন,

 

আজ এখানে ঘুরতে এসে

ভালো লাগলো খুব

কালকে সবাই আসবো আবার

গল্পে দেবো ডুব।

 

সবার চোখে হতাশার ছাপ । গল্প না শুনতে পারায় মলিন হলো মুখ ।‌ বাইরে আসা ছেলেরা ঘোর আপত্তি জানালো । একজন উঁচু গলায় বললো‌ ,আমরা গল্প শুনতে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে তো তাফসীর মাহফিল হয়ে গেলো ।‌ আর একজন বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বললো আগে জানলে মাইক, প্যান্ডেলের ব্যবস্থা করতাম । ওদের এমন আচরণে সাজিদ সাফিন ও রেগে যাচ্ছিল । গরু নিয়ে বাড়ির পথে ফেরা কজন কৃষক ও এগিয়ে আসছিল এদিকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে‌ দেখে মামা মুখ খুললেন। বললেন,কালকে আবার গল্প আসর হবে ইনশাআল্লাহ। তবে এতো দূরে নয় । বিকাল বেলা বাড়ির পাশে ঐ প্রাইমারী স্কুলের মাঠে । তখন তোমরা সবাই হাজির হবে । অন্য বন্ধুদের ও দাওয়াত পৌঁছাবে । মামার হাসি মুখের কথায় ওরা মোটামুটি আশ্বস্ত হলো । তবে ওরা ওয়াদা নিয়ে ছাড়লো । মামাও প্রতিশ্রুতি দিলেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন শহরের ছেলেরা স্মার্টফোনে গেম ছাড়া কিছু বোঝেনা ।

 

আর গ্রামের ছেলেরা এখনো এতোটা গল্প পাগল যে ‌ একটা ছোট খাটো ঝামেলা বাঁধিয়ে দিল ।‌ এতে তিনি একইসঙ্গে অবাক এবং খুশিও হয়েছেন ‌। তাই তিনিও সুযোগ বুঝে ওদের লেখালেখি করার শপথ করালেন। ওরাও হাসি মুখে অঙ্গিকার করলো‌ । বিদায় বেলা সকলে সমস্বরে বলল,

 

আমরা তরুণ আমরা কিশোর

লেখাপড়া করবো

সত্য ন্যায়ের মশাল দিয়ে

সমাজটাকে গড়বো ।

 

লেখালেখি করবো সবাই

দেশ -জনতার পক্ষে

দীন-শরীয়াত মানবো সবাই

অসীম সাহস বক্ষে ।

 

আমীন। ছুম্মা আমীন। ইয়া রাব্বিল আলামীন। আসসালামু আলাইকুম ওরাহমাতুল্লাহ ‌।

 

 

লিখেছেনঃ শরিফ আহমাদ

লেখক ও শিক্ষক