কওমী মাদ্রাসাপ্রতিষ্ঠান পরিচিতি

লালবাগ জামেয়ার পরিচিতি [ প্রতিষ্ঠান পরিচিতি ]

 

লালবাগ জামেয়া

 

লালবাগ জামেয়ার ব্যতিক্রমী শিক্ষা সূচনাঃ

 

ঢাকার অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দীনি বিদ্যাপীঠ জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া, লালবাগ, ঢাকা ৷ যা লালবাগ মাদরাসা নামে খ্যাত ৷

 

১৯৫০ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ১৩৭০ হিজরীর শাওয়াল মাস। মোঘলদের ঐতিহ্য প্রাচীর লালবাগ কেল্লা ঘেঁষে মনোরম পরিবেশে গড়ে উঠেছে সুবিশাল লালবাগ শাহী মসজিদ। তাকে কেন্দ্র করেই মসজিদের আঙিনাতে কোন এক শুভক্ষণে কুরআন হাদিসের দরসের সূচনা হয়।

 

লালবাগ জামেয়ার সূচনাটি ছিল কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। অন্যান্য মাদ্রাসায় যেভাবে প্রাথমিক স্তরের ক্লাস থেকে শুরু করা হয় লালবাগ সেরকম হয়নি ৷ সেই স্বাভাবিক নিয়ম ভেঙ্গে সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসের দরসের মাধ্যমে কিতাবী দরসের সূচনা করেছিল। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে সকল ক্লাস ও বিভাগে ছাত্রদের ভর্তির সুযোগ দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানকে একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়।

 

উল্লেখ্য যে, হযরত যাফর আহমদ উসমানী রহ. ঢাকায় অবস্থানকালে একবার স্বপ্নযোগে রাসূলুল্লাহ সা. কে লালবাগ শাহী মসজিদের হাউজে অজু করতে দেখেছেন। মনে করা হয় এটাই আল্লাহর দরবারে লালবাগ জামেয়ার মকবুলিয়্যাতের ইশারা ছিল।

 

লালবাগ জামেয়ার ইতিকথাঃ

 

১৯৫০ খৃস্টাব্দ মুতাবেক ১৩৭০ হিজরী সনের শাওয়াল মাস। হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ. এর সুযোগ্য ভাগ্নে ও তার খলিফা ৷ ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা যাফর আহমদ উসমানী রহ. তখন ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। স্থানীয় উলামায় কেরাম তার কাছে একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রস্তাব পেশ করেন ৷  তিনি তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন করেন ৷ এবং নিজে সক্রিয় সহযোগিতা দানের আশ্বাস দেন। কিন্তু তখনও মাদরাসা প্রতিষ্ঠার জন্য সুবিধা মত স্থানের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না।

লালবাগ জামেয়ার ইতিকথা

মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর তখন লালবাগ শাহী মসজীদের খতিব। অত্র এলাকায় একটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করার প্রয়োজনীয়তা তিনি খুব গভীরভাবে অনুভব করেন ৷ সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা ভাবতে লাগলেন। এবং বিষয়টি নিয়ে মহল্লাবাসীদের সাথে পরামর্শ করলেন। অতঃপর মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. ৷ মাওলানা মুফতি দ্বীন মুহাম্মাদ খান সাহেব রহ. ৷ মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ. ৷ মাওলানা আব্দুর রহমান বেখুদ রহ. এর মত শীর্ষ স্থানীয় ওলামায়ে কেরাম  প্রতিষ্ঠানটি শুরু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সাথে নেন স্থানীয়দের ৷

 

মাওলানা যফর আহমদ উসমানী রহ. এসে  দুআর মাধ্যমে এই আদর্শ প্রতিষ্ঠানটির সূচনা করেন। সর্বসম্মতিক্রমে এর নামকরণ করা হয় ‘জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া’।

সূচনাকাল থেকেই হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. এর সাথে সম্পৃক্ত ৷ তার মতো বুজুর্গ ও সুদক্ষ ব্যক্তির বলিষ্ঠ পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানটি সুনাম কুড়ায় ৷ আর তা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ৷ শিক্ষার মান উন্নয়ন ও বহুমুখী প্রকল্প বাস্তবায়নের পথ উন্মুক্ত হয়।

 

হযরত হাফেজ্জী হুজুর এর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন ৷ ছিলেন প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ৷ একজন একনিষ্ঠ পরিচালক এবং তার রূহানী তাওয়াজ্জুহই প্রতিষ্ঠানটিকে মাকবুলিয়্যাতের অনন্য এক স্তরে পৌঁছে দেয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত উনিই এর পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। ১৪০৭ হিজরির ৮ই রমজান হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ এর ইন্তেকালের পর মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ. এর পরিচালনার দায়িত্বে নিযুক্ত হন।

 

লালবাগ জামেয়ার অবদানঃ

 

জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া উপমহাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় অর্ধশতাব্দি ধরে দীনি শিক্ষায় অবদান রেখে আসছে ৷

তাফসির, হাদিস, ফিকহ, উসুলে ফিকহ, বালাগাত, মানতেক, নাহু, সরফ, আরবী, উর্দু ও ফার্সি ও বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাসসহ ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির চর্চা ব্যাপকভাবে করে আসছে।

লালবাগ জামেয়ার অবদান

বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে ইসলামী আদর্শের চেতনায় গড়ে ওঠা ভাবমূর্তি তৈরীর ক্ষেত্রে লালবাগ জামেয়ার অবদানের কথা সমাজের প্রত্যেকটি বিবেকবান ও সচেতন ব্যক্তি নির্দ্বিধায় স্বীকার করবে। এ পাহাড়সম ত্যাগ ও তিতিক্ষার কারণে জামেয়ায় কার্যক্রম আজ শুধু দ্বীনী পরিমন্ডলেই নয় বরং সর্ব মহলেই সমাদৃত।

 

বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়েও মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই এর বেশ নামযশ  রয়েছে। আর এর অন্যতম কারণ হল, লালবাগ জামেয়া শুধুমাত্র গতানুগনিক ধারায় তার কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিকতার ভেতরই সীমাবদ্ধ রাখেনি বরং এ শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে দ্বীনী আন্দোলন ও ইসলামী বিপ্লবে ভূমিকা রেখে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে।

দেশ, জাতি ও দ্বীনের সর্বক্ষেত্রে স্বতন্ত্র চিন্তার এই মাকতাবায়ে ফিকির অনেকের কাছে একটি সার্বজনীন চিন্তা চেতনা লালনের মূলকেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত। এই নীতির ফলেই বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এবং বহির্বিশ্বেও এই জামেয়ার কৃতি সন্তানেরা দ্বীন ও ঈমানের দাবী পূরণের লক্ষ্যে অগ্রণীভাবে সিপাহসালার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দীর্ঘ সময় ধরে যারা দরস ও তাদরীস, দাওয়াত ও তাবলীগ, তাকরীরাত ও তাসনিফাত এবং ইসলামী রাজনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে যারা নেতৃত্ব দিয়ে আসছে তারা অত্র জামেয়ার কৃতি সন্তানদেরই একজন।

মুসলমানদের চিন্তা চেতনাকে ইসলামের সঠিক আদর্শের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত রাখতে বিভিন্ন সময় সংস্কারমূলক ও বৈপ্লবিক কর্মসূচী হাতে নেয়ার ক্ষেত্রে লালবাগ জামেয়ার ভূমিকা সর্বদা চোখে পড়ার মত। তাই মানুষ এ প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে বিশেষ শ্রদ্ধা ভক্তি পোষণ করে। এবং ইসলামের উপর আঘাতের প্রতিবাদে লালবাগ জামেয়ার প্রতিবাদী ভূমিকার ফলে ইসলাম বিদ্বেষীদের বেশ রোষানলেও পড়তে হয়েছে প্রতষ্ঠানটিকে।

 

তারা জামেয়ার নামে গুজব রটিয়ে অনাস্থা সৃষ্টিসহ আরো নানান প্রতিবন্ধকা তৈরীর অপচেষ্টাও করেছে বহুবার। কিন্তু যাবতীয় বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে লালবাগ জামেয়া তার সুমহান লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলেছে অবিরাম গতিতে। পাহাড়ের ন্যায় অটল অবিচল থেকে পাশ্চাত্যের সভ্যতা সংস্কৃতির মোকাবেলা করে যাচ্ছে আজ আবদি।

 

এ কথা সর্বজনবিদিত যে আজ বাংলাদেশের যত প্রসিদ্ধ ওলামায়ে কেরাম বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে দায়িত্বশীল হয়ে ইলমে দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন তাদের সিংহভাগই এই লালবাগ জামেয়ার সনদপ্রাপ্ত কৃতিসন্তান। এটি লালবাগ জামেয়ার জন্য বিরাট গর্বের বিষয়। লালবাগ জামেয়ার ইতিহাস ও তথ্য অনুসন্ধান করলে এ কথাটিই স্পষ্ট হবে যে এই প্রতিষ্ঠানটি কোন গতানুগতিক সনাতনী বিদ্যা নিকেতন নয়, বরং এটি ইসলামের পুনরজাগরণে মুসলিম মিল্লাতের এক মহান বিপ্লবের নাম।

 

সামাজিক ক্ষেত্রে লালবাগ জামেয়ার অবদানঃ

 

লালবাগ জামেয়া প্রতিষ্ঠার পর থেকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে সেই সঙ্গে জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম ও সামাজিক উন্নয়নে এর ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডোসহ যেকোণ দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে এখানকার ছাত্র শিক্ষকগণ সাধ্যমত সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে দুর্গত মানুষোদের পাশে দাড়িয়েছেন সংঘবদ্ধভাবে। দেশের ভয়াবহ দুর্যোগকালে অত্র জামেয়ার ছাত্র শিক্ষকগণ ত্রাণ সামগ্রী ও নগদ অর্থ দিয়ে প্রয়োজনে মাদরাসার ক্লাস বন্ধ রেখে দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় গিয়ে দুঃস্থ ও বিপদগ্রস্থ মানুষদের হাতে হাতে সাহায্য পৌঁছে দিয়ে এসেছেন। গত বছর উত্তরাঞ্চলে বন্যার্তদের সহায়তায় পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ ও সম্প্রতি মায়ানমারের গণহত্যার কবল থেকে প্রাণ নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়া অসহায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাহায্যার্থে দুটি সফল ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে লালবাগ জামেয়া।

 

রাজনীতির মায়দানে লালবাগ জামেয়ার অবদানঃ

 

বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে মাদরাসা কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনীতি একটি স্পর্শকাতর বিষয় হিসেবে বিবেচিত হলেও লালবাগ জামেয়া তার সূচনালগ্ন থেকেই এ ব্যাপারে কখনোই কোন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেনি। লালবাগ জামেয়া তার আদর্শকে শুধু অক্ষরজ্ঞানের ভেতরেই সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং তার সেই আদর্শ বাস্তবায়নে সদা তৎপর ছিল।

রাজনীতিতে লালবাগ জামেয়ার অবদান

রাজনীতির ক্ষেত্রে তার বৈপ্লবিক ভূমিকা আজও সর্ব মহলে স্বীকৃত। অত্র জামেয়ার প্রথম প্রিন্সিপাল শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. তার প্রতিবাদী ভূমিকার কারণে আজ শুধু বাংলাদেশেই নন, পুরো উপমহাদেশে “মুজাহিদে আজম” উপাধীতে অমর হয়ে আছেন। সে আমলে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে এমন লোক খুজে পাওয়া ছিল বেশ দুস্কর। কিন্তু শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. আইয়ুব খানের যে কোন ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবাদে গর্জে উঠতেন। মুসলিম পারিবারিক আইনের বিরুদ্ধে তার আন্দোলন আইয়ুব খানের ক্ষমতার ভিত কাপিয়ে তুলেছিল। তিনি তৎকালীন শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। শিক্ষা মন্ত্রী আতাউর রহমানের ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তার আন্দোলনে দেশবাসী অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিল।

 

চাঁদ দেখা কমিটি নিয়ে ঈদ ও রমজানের চাদের ব্যাপারে ভুল সিদ্ধান্ত দিলে শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. তার সত্যতা চ্যালেঞ্জ করে জনগণকে নিজের রায় জানিয়ে দিতেন। এদেশের জনগণও লালবাগ থেকে শামসুল হক ফরদপুরী রহ. এর সিদ্ধান্ত শোনার অপেক্ষায় থাকত। এই মহামণিষী খ্রিষ্টান মিশনারীদের ইসলামবিরোধী দাওয়াতী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তার কার্যক্রম প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছিলেন।

 

তিনি পাকিস্তানের ইসলামী রাষ্ট্রের মূলনীতির ঐতিহাসিক ২২ দফা রচয়িতাদের মাঝে অন্যতম ছিলেন। যফর আহমদ উসমানীও ২২ দফার রচয়িতাদের মধ্যে বিশেষ ভুমিকা পালন ছিলেন। এবং পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীন পাকিস্তানের পতাকা সর্বপ্রথম যিনি উত্তোলন করেন তিনি হলেন আল্লামা যফর আহমদ উসমানী। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তান গঠনের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে অসংখ্য সভা সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. ও উনার সাথে অনেক জায়গায় উপস্থিত ছিলেন। শামসুল হক ফরিদপুরী রহ মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন।

 

হাফেজ্জী হুজুর রহ. প্রথমে রাজনীতিতে না আসলেও উলামায়ে কেরামের কামিয়াবীর জন্য সর্বদা দুয়া করতেন। ১৯৮১ সালে সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়িয়ে সারাবিশ্বে ঝড় তুলেছিলেন তিনি। খানকা থেকে বেরিয়ে তিনি তওবার রাজনীতির ডাক দিলেন।

 

নির্বাচন শেষে স্থায়ীভাবে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন লালন করে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন। এরপর শুধু বাংলাদেশেই না স্বল্প সময়ের ভেতর ইসলামী বিশ্ব তাকে শান্তির দূত হিসেবে চিহ্নিত করে। ইরাক-ইরান ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধে শান্তির দূত হিসেবে মীমাংসার ডাক আসে।

 

১৯৮২ সালে তিনি ইরান সফর করেন। এছাড়াও স্বৈরশাসন ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনি প্রকাশ্যে জিহাদ ঘোষণা করেন।

 

হাফেজ্জী হুজুর যেই বিপ্লবের ধারা সৃষ্টি করে গেছেন তার ইন্তেকালের পর সেই ধারাকে অব্যাহত রাখেন অত্র জমেয়ার পরবর্তী প্রিন্সিপাল মুফতি ফজলুল হক আমিনী রাহঃ। তার সময়কালে সরকারের ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডের প্রতিবাদে যে হুংকার তিনি দিতেন এতে জালিম শাহীর মসনদ কেপে উঠতো।

 

আজও ইসলামের উপর কোন আঘাত আসলে জাতি একজন মুফতি আমিনীর অভাব গভীরভাবে অনুভব করে। অত্র জামেয়ার অধিকাংশ দায়িত্বশীল শিক্ষকমন্ডলী ইসলাম বিরোধীদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে কখনো পিছপা হননি। এখানকার ছাত্ররাও শিক্ষকদের নির্দেশে পড়ালেখার সকল বৈশিষ্ট্যকে ঠিক রেখে ইসলাম বিরোধী সকল কার্যক্রমে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

 

রাজনীতির ক্ষেত্রে এইসব অবদান, লালবাগ জামেয়ার প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক। এছাড়াও বাংলাদেশের সর্বত্র ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব যারা দিয়ে আসছে তাদের অধিকাংশই লালবাগ জামেয়ার সন্তান। মোটকথা ইসলামী আদর্শে রাজনীতির ক্ষেত্র তৈরীতে লালবাগ জামেয়ার অসামান্য অবদান চির অমলান থাকে যাবে।

 

লালবাগ জামেয়ার ১১ দফাঃ

 

১. সর্বক্ষেত্রে সালফে সালেহীন তথা আমাদের অনুকরণীর পূর্ব পুরুষদের শিক্ষা দীক্ষা ও নীতির পূর্ণ অনুসরণ ও ইসলামের সেবায় তাদের অনুসৃত পদ্ধতির পূর্ণ অনুকরণ করা।

২. মুসলিম জনসাধারণের সাথে সুসম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ় ও সম্প্রসারিত করা। ইসলামবিরোধী শক্তির বিষাক্ত আক্রমণ থেকে সাধারণ মুসলমানের ঈমান আকিদাকে সুরক্ষিত রাখা। মুসলিম হিসেবে প্রত্যেককে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলা।সেইসঙ্গে এই ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা দেয়া যে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দান করার অর্থ ছাত্রদের উপর অনুগ্রহ বা দয়া করা না বরং এখানে দান করে ইসলামী শিক্ষা দীক্ষা ও সভ্যতা সংস্কৃতির ভিত মজবুত করণে ভূমিকা রাখা মুসলমান হিসেবে তার উপর অর্পিত দায়িত্বসমূহের একটি বিশেষ অংশমাত্র।

লালবাগ জামেয়ার ১১ দফাঃ

৩. আধুনিক সভ্যতার নামে পাশ্চাত্যের ইসলামবিরোধী যেসব সংস্কৃতি আমাদের দেশে আমদানী করা হয়েছে বা হচ্ছে তার ভয়াল থাবা থেকে মুসলমান জনসাধারণকে সচেতন করে তোলা। যাতে জনগণ সেইসব ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত থাকতে পারে।

 

৪. আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুব সমাজের মন-মস্তিষ্ককে পাশ্চাত্য শিক্ষার কুপ্রভাব থেকে মুক্ত করে তাদের ভেতর আত্মমর্যাদাবোধ ও দেশপ্রেম সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালানো।

৫. হানাফী মাযহাবের পুরোপুরি অনুসরণপূর্বক কুরআন হাদিস দ্বারা স্বীকৃত অন্যসব মাযহাবের প্রতি সুধারণা পোষণ করা। সত্যের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত প্রত্যেক মাযহাবকেই সঠিক মনে করা এবং সেসবের প্রতি তুচ্ছ ধারণা না রাখা। কুরআন হাদিসের অনুসরণের নামে ভন্ড ফকিরদের পুজা করে ইসলামকে হাসি তামাশার পাত্র বানানোর ষড়যন্ত্র থেকে মুসলিম সমাজকে বিরত রাখা।

৬. দ্বীনী ইলমের হাকিকত, তাসাউফ তথা আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জন এবং তাযকিয়ায় নফস তথা আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে ইসলামী শরিয়তের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌছা।

৭. বিদআত ও কুসংস্কার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থেকে ইখলাস ও নিষ্ঠার সাথে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামী শরিয়তের বাস্তব প্রতিফলন ঘটানো।

৮. মুসলিম রাষ্ট্র বা সরকারের আনুগত্য এবং পূর্ণ সমর্থন করা। এর বিরুদ্ধাচারণকে সম্পূর্ণ বেআইনি মনে করা। যদি রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা অজ্ঞতাবশত ইসলাম বা শরিয়তবিরোধী কার্যকলাপে মুসলিম জনতাকে বাধ্য করার অপচেষ্টা চালায় তবে তার প্রতিরোধে সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৯. আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষত বিজ্ঞানের সকল প্রযুক্তিকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহায়ক ও উপকারী মনে করা। বিজ্ঞানের আধুনিক প্রযুক্তিকে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক মনে না করা। ঠিক একইভাবে প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে তাসাউফের পরিপন্থী মনে না করা। আধুনিক শিক্ষা বা বিজ্ঞান প্রযুক্তির নামে যদি বেহায়াপনা, উলঙ্গপনা এবং খোদায়ী বিধানের বিরোধীতাকে উস্কে দেয়ার অপচেষ্টা চালানো হয় তাহলে তা প্রতিরোধের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১০. রাজতন্ত্র ও পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ ইসলাম পরিপন্থী মনে করা। ইসলামী গণতন্ত্র এবং সৎ ন্যায় পরায়ণ ও ইসলামী আদর্শে আদর্শবান ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত ইসলামী শুরায়ী নীতিকে সমর্থন ও অনুমোদন দেয়া।

১১. জ্ঞানার্জনের একটি মাত্র উদ্দেশ্য থাকবে। আর তা হল, এই জ্ঞানের আলোকে নিজের জীবনকে গড়ে তোলা।

 

দারুল ইকামার কানুনসমূহ : 

 

দারুল ইকামায় অবস্থানরত প্রত্যেক ছাত্র নিম্নোক্ত কানুন ও নিয়মাবলি পুরোপুরি মেনে চলতে বাধ্য থাকবে।অমান্যকারী শাস্তি বা বহিস্কারযোগ্য হবে।

১. দশ বছরের ছোট কোন ছাত্র নিজ জিম্মাদার ব্যাতিত দারুল ইকামায় অবস্থান করতে পারবেনা।

২. ক্লাস টাইম ছাড়া দারুল ইকামায় অবস্থানরত ছাত্ররা মাগরিবের পর থেকে রাত দশটা অথবা সাড়ে দশটাপর্যন্ত এমনভাবে তাকরার মুতালা এবং লেখাপড়ায় লিপ্ত থাকবে যাতে অন্যের পড়ালেখায় কোন ধরণের ব্যাঘ্যাতসৃষ্টি না হয়।

দারুল ইকামার কানুনসমূহ : 

৩. হেফজ ও মক্তব বিভাগের ছাত্ররা নিজেদের বিভাগ কর্তৃক নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী লেখাপড়ায় লিপ্ত থাকবে।

৪. জামেয়ার প্রত্যেক ছাত্রের  আচার-আচরণ, চালচলন, পোশাক-পরিচ্ছেদ, দাড়ি, টুপি পুরোপুরি সুন্নাত মুতাবেক হতে হবে। সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে এমন কোন আচার-আচরণ এবং কাজ-কর্মে কোন ছাত্র জড়িত হতে পারবেনা।

৫. জামেয়ার ছাত্রদের জন্য যে কোন ছাত্র সংগঠন এবং অন্য যে কোন দল সংগঠন বা সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণ করা বা দলীয় কোন কর্মতৎপরতা চালানো সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। প্রমাণিত হলে তাৎক্ষনিকভাবে মাদরাসা থেকে বহিস্কার করা হবে এতে কোন ওজর আপত্তি গ্রহণযোগ্য হবেনা।

৬. নিজেরা কোন প্রকার ঝগড়া বিবাদে জড়াবে না। কোন কারনে এরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে দারুল ইকামার উস্তাদদের জানিয়ে তার সমাধান করিয়ে নিতে হবে।

৭. মাদরাসার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোন ছাত্র বহিরাগত কোন ব্যক্তিকে দারুল ইকামায় ডেকে আনতে পারবেনা।

৮. দারুল ইকামায় অবস্থানরত কোন ছাত্র দায়িত্বশীল উস্তাদদের অনুমতি ছাড়া রাতে অন্য কোন ছাত্রের সিটে কিংবা দারুল ইকামার বাইরে অবস্থান করতে পারবেনা।

৯. তাকরার এবং মুতালার সময় গল্প গুজব করা বা পাঠ্যকিতাব ব্যাতিত অন্য বইপুস্তক পড়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমনটি প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

১০. অনুমতি ছাড়া এক তলার ছাত্র অন্য তলায় এবং এক রুমের ছাত্র অন্য রুমে যেতে পারবেনা।

১১. রাত দশটা অথবা সাড়ে দশটা থেকে ফজর পর্যন্ত সময় বিশ্রাম ও ঘুমের জন্য নির্ধারিত। এ সময়ে কোন ছাত্র অন্যের বিশ্রাম বা নিদ্রায় ব্যাঘ্যাত সৃষ্টি করতে পারবেনা। কোন ছাত্র যদি এ সময়ে ব্যক্তিগত মুতালা করতে চায় তাহলে সে বারান্দা বা মসজিদে নির্জনে মুতালা করতে পারবে।

 

১২. প্রত্যেক ছাত্র দারুল ইকামার আসবাবপত্রের সদ্ব্যবহার এবং তা যথাযথ তদারকি ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বশীল হবে। দারুল ইকামার আসবাব পত্র বিনষ্ট হওয়া থেকে সদা সতর্ক থাকবে। প্রতিদিন নিজ কামরা এবং প্রতি সপ্তাহে কামরা ও তার আশপাশ পরিস্কার করার তালিকা করে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করবে। ব্যবহার্য কাপড় ও অন্যান্য আসবাবপত্র গোছগাছ করে রাখতে হবে। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখবে।

 

পড়ুন – সেরা ১০ টি কওমী মাদরাসা 

 

১৩. দারুল ইকামার জিম্মাদার কর্তৃক প্রত্যেক ছাত্রের সিট নির্ধারিত হবে। সিট পরিবর্তনের এখতিয়ার কোন ছাত্রের থাকবেনা।

১৪. দারুল ইকামায় অবস্থানরত কোন ছাত্র নিজস্ব কোন মেহমানকে মুনতাযিম উস্তাদের অনুমতি ব্যাতিত নিজ বা অন্য কারো সিটে থাকার ব্যবস্থা করতে পারবেনা।

১৫. প্রত্যেকে ছাত্র জামাতের সঙ্গে লালবাগ শাহী মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় করবে। আশেপাশের কোন মসজিদে নামাজ আদায়ের অনুমতি থাকবেনা। প্রমাণিত হলে শাস্তিযোগ্য হবে। ফজরের আযানের সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে জাগতে হবে। প্রত্যেক নামাজের দশ মিনিট পূর্বে রুম থেকে বের হয়ে মসজিদে চলে আসতে হবে।

 

১৬. বাদ ফজর নিয়মিতভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে এবং তাহাজ্জুদসহ নফল ইবাদাত বন্দেগীর অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হতে হবে।

 

১৭. ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় কোন কাজ থাকলে তা আসরের পর থেকে মাগরীবের দশ মিনিট পূর্বে সেরে মাগরিবের নামাজ লালবাগ শাহী মসজীদে আদায় করতে হবে।

১৮. চরিত্র বিধ্বংসী কোন বই পুস্তক পড়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অবসর সময়ে আকাবের আসলাফদের কিতাবাদি, মাওয়ায়েজ, মালফুজাত এবং ইসলামের বিভিন্ন বিষয়াদির কিতাব মুতালা করবে।

১৯. ক্যামেরা রাখা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কোন ছাত্র নিজ বা অন্য কোন ব্যক্তির মোবাইল ফোন নিজের কাছে রেখে ব্যবহার করতে পারবেনা। কারো কাছে এই জিনিষ পাওয়া গেলে তা সঙ্গে সঙ্গে বাজেয়াপ্ত করা হবে।

২০. কোন ছাত্র টিউশনী করতে পারবেনা। বা নিজেও অন্য কোথাও অনুমতি ব্যতিত কোন প্রশিক্ষন কোর্সে অংশগ্রহণ করতে পারবেনা। এমনটি প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

২১. প্রত্যেক ছাত্র দৈনন্দিন চব্বিশ ঘন্টা সময়ের নিজামুল আওকাত বানিয়ে তা নিজ সিটের পেছনে টানিয়ে রাখবে।

২২. ক্লাশের সময় এক দুই ঘন্টা ছুটি নেয়ার প্রয়োজন হলে তা সংশ্লিষ্ট ক্লাসের উস্তাদ থেকে নিতে হবে। নূন্যতম একদিনের ছুটি নিতে হলে তা দারুল ইকামার মুনতাযিমের লিখিত সুপারিশ নিয়ে প্রিন্সিপাল সাহেবের মঞ্জুরী নিতে হবে। অবশ্য ক্লাশের সময় ব্যাতিত স্বল্প সময়ের জন্য কোথাও যেতে হলে দারুল ইকামার সংশ্লিষ্ট মুনতাযিমের অনুমতি নিয়ে যেতে হবে।

২৩. এছাড়া মাদরাসা কর্তৃপক্ষ অবস্থার প্রেক্ষিতে যে সময় যে নিয়ম জারি করবেন তা প্রত্যেক ছাত্রের জন্য মেনে চলা বাধ্যতামূলক হবে।

 

Related Articles