ধর্ম

আকিকা করার নিয়ম । আকিকার গুরুত্ব ও ফজিলত । আকিকার দোয়া মাওলানা শরিফ আহমাদ

আকিকা করার নিয়ম । আকিকা করার গুরুত্ব ও ফজিলত । আকিকার দোয়া ।

 

আল্লাহ তাআলার দেওয়া শ্রেষ্ঠ একটি নেয়ামত হলো সন্তান । সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার রয়েছে অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য । তার মাঝে অন্যতম একটি হলো আকিকা করা । কিন্তু সমাজে আকিকা নিয়ে অনেক বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির লক্ষ করা যায় ।

 

শহর-গ্রামে আকিকা করার অনেক ভুল রীতি ও কুসংস্কার বারবার ঘুরেফিরে আসে । তাই আকিকা সংক্রান্ত জরুরী পয়েন্টগুলো ধারাবাহিক ভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে ।

 

 

আকিকা অর্থ কি ?

 

আকিকা একটি আরবী শব্দ । শব্দটির অর্থ হলো কর্তন করা ।

 

আকিকা কাকে বলে ?

 

ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় নবজাতক ছেলে-মেয়ের জন্মের সপ্তম দিন পশুর যে রক্ত প্রবাহিত করা হয় তাকে আকিকা বলা হয় ।

 

আকিকার হুকুম কি ?

 

আকিকা করা একটি সুন্নাত বা মুস্তাহাব আমল । নবজাতক সন্তানের পিতা বা অভিভাবকের পক্ষে আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় পূর্বক কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ আকিকা করা মুস্তাহাব । সহীহ তরীকায় করলে সওয়াব আছে । না করলে কোনো গুনাহ নেই ।

 

আকিকার গুরুত্ব ও ফজিলত

 

আকিকর বিষয়টি স্বয়ং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে সহীহ ও মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রমাণিত । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন নাতি হযরত হাসান ও হযরত হুসাইন রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুমার আকিকা করেছেন ।

 

জানুন – গোসল ফরজ অবস্থায় সেহরি খাওয়া যাবে কি? 

 

এবং তিনি বলেছেন ছেলে মেয়ের জন্য আকিকা । এদের পক্ষ থেকে রক্ত প্রবাহিত করাও এবং এর মাধ্যমে ময়লা ( মাথার চুল) দূর করো । (সহীহ বুখারী )

আকিকা সম্পর্কে তিনি আরো বলেছেন প্রত্যেক শিশুরই আকিকা জরুরী ।‌ (আবু দাউদ, হাদীস নং ২৮৪০ মুসনাদ আহমদ, হাদীস নং ২০০৯৫)

 

হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ইহুদিরা পুত্র সন্তানের    আকিকা করত । কিন্তু কন্যা সন্তান আকিকা করত না ।‌ তোমরা পুত্র সন্তানের জন্য দুটি ছাগল এবং কন্যা সন্তানের জন্য একটি ছাগল দিয়ে হলেও আকিকা করো ‌। (বায়হাকি, সুনানে কুবরা: ১৯৭৬০; মুসনাদ বাযযার: ৮৮৫৭)

 

 

সঠিক নিয়মে আকিকা করা হলে এর মাধ্যমে সন্তানের বিপদ আপদ দূর হয় ‌। সবচেয়ে বড় উপকার হলো আকিকার মাধ্যমে কেয়ামতের দিন পিতা-মাতা-সন্তানের সুপারিশের উপযুক্ত হয় ‌।

 

এছাড়াও আকিকার মাধ্যমে দানশীলতার বিকাশ ঘটে । গরিব মিসকিন ও আত্মীয় স্বজনের হক কিছুটা হলেও আদায় করা যায় । বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সম্পর্ক বাড়ে । পরস্পরে আন্তরিকতাপূর্ণ ভালোবাসা সৃষ্টি হয় ।

 

 

আকিকা করার নিয়ম

 

সন্তান জন্মগ্রহণ করার পর সপ্তম দিনে আকিকা করতে হয় ‌। সেই সপ্তম দিনে সন্তানের মাথার চুল মুন্ডন করে তার সমমূল্যের টাকা দান করতে হয় । এ সম্পর্কে দুটি হাদীস দেখুন ।

১ নং হাদীস

عن سمرة بن جندب أن رسول الله -صلى الله عليه وسلم- قال « كل غلام رهينة بعقيقته تذبح عنه يوم سابعه ويحلق ويسمى

আকিকা করার নিয়ম

হযরত সামুরা বিন জুনদুব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত ।‌ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন প্রত্যেক বালকের পক্ষ থেকে আকিকা হলো বন্ধক স্বরুপ ।

 

যা তার পক্ষ থেকে সপ্তম দিনে জবাই করবে এবং তার মাথা মুন্ডাবে এবং তার নাম রাখবে । (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২৮৪০, সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদীস নং-১৯০৪৭, সুনানে দারামী, হাদীস নং-১৯৬৯, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২০০৮৩)

 

আকিকা সম্পর্কে  হাদীস

 

عن جعفر بن محمد عن أبيه أنه قالوزنت فاطمة بنت رسول الله صلى الله عليه وسلم شعر حسن وحسين وزينب وأم كلثوم فتصدقت بزنة ذلك فضة

হযরত যাফর বিন মুহাম্মদ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তার পিতা বলেছেন হযরত ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত হাসান , হযরত হুসাইন , হযরত জয়নব ও হযরত উম্মে কুলসুমের চুল ওজন করে সেই পরিমাণ রুপা সদকা করে দিয়েছেন । ( মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং-১৮৩৯, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৮২৬২, সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদীস নং-১৯০৭৯)

 

সপ্তম দিনে আকিকা করতে না পারলে ১৪তম দিনে আকিকা করবেন । না পারলে ২১ তম দিনে করবেন ।

 

 

যদি তাও না পারা যায় তাহলে সন্তান বালেগ হওয়ার আগ পর্যন্ত যেকোনো দিন করতে পারবেন । তবে এক্ষেত্রে সন্তান জন্ম নেওয়ার পর থেকে সপ্তম দিন গণনা করে সপ্তম দিনের দিন আকিকা দেওয়াটাই উত্তম বলে ফুক্বাহায়ে কেরাম মত দিয়েছেন ।

عن أم كرز قالت قالت امرأة من أهل عبد الرحمن بن أبي بكر إن ولدت امرأة عبد الرحمن غلاما نحرنا عنه جزورا فقالت عائشة : لا بل السنة عن الغلام شاتان مكافئتان وعن الجارية شاة يطبخ جدولا ولا يكسر لها عظم فيأكل ويطعم ويتصدق يفعل ذلك في اليوم السابع فإن لم يفعل ففي أربع عشرة فإن لم يفعل ففي إحدى وعشرين

 

হযরত উম্মে করজ বলেন আব্দুর রহমান বিন আবী বকরের পরিবারে এক মহিলা বলেন , আব্দুর রহমানের স্ত্রী ছেলে সন্তান প্রসব করে । তখন আমরা তার পক্ষ থেকে একটি ভেড়া জবাই করেছি । তখন হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহা বললেন এমনটি- বরং পদ্ধতি হলো ছেলের পক্ষ থেকে দুটি সমান পর্যায়ের বকরি আর মেয়ের পক্ষ থেকে একটি বকরি দিয়ে আকিকা করবে ‌।

তারপর এটিকে রান্না করবে । তবে এর হাড্ডিকে ভাংবে না । তারপর তা নিজে খাবে । অন্যকে খাওয়াবে এবং দান করবে ‌।‌

তারপর এটিকে রান্না করবে, তবে এর হাড্ডিকে ভাঙ্গবে না। তারপর তা নিজে খাবে, অন্যকে খাওয়াবে, এবং দান করবে।

 

 

এ কাজগুলো করবে সপ্তম দিন । সেদিন সক্ষম না হলে ১৪ তম দিন । সেদিনও সক্ষম না হলে ২১ তম দিন করবে আকিকা ‌। (মুসনাদে ইসহাক বিন রাহহুয়া, হাদীস নং-১২৯২)

 

বিশেষ দ্রষ্টব্য:

সন্তান বালেগ হওয়ার পর আকিকার গুরুত্ব বাকি থাকে না । তবুও যদি কেউ দিয়ে থাকে তাহলে আদায় হয়ে যাবে ।

 

আকিকার পশুর সংখ্যা

 

ছেলে সন্তানের জন্য দুইটি বকরি আকিকা করতে হয়

। আর কন্যা সন্তানের জন্য একটি বকরি আকিকা করতে হয় ।

উম্মে কুরযিল কাবিয়্যাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহা বলেন , আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে ছেলের জন্য দুইটি একই মানের বকরি ও মেয়ের পক্ষ থেকে একটি বকরি আকিকা দিবে । ( সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২৮৩৬, সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-১৫১৩, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-১৯৬৬, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৫৩১৩, মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদীস নং-৪৬৪৮, মুসনাদে ইসহাক বিন রাহহুয়া, হাদীস নং-১২৯০)

আকিকার পশুর সংখ্যা

 

হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহা থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে ছেলে সন্তানের জন্য দুইটি সমবয়সী ছাগল আর মেয়ে সন্তানের জন্য একটি ছাগল দিয়ে আকিকা করার জন্য নির্দেশ করেছেন । (জামে তিরমিজি ১/১৮৩)

বোঝা গেল ছেলের জন্য দুটি বকরি ।আর কন্যার জন্য একটি বকরি । গরু ,উট ও মহিষে হলে ছেলের জন্য দুটি শরীকানা ও মেয়ের জন্য একটি শরীকানা দিয়ে আকিকা করা যাবে ।

 

বিশেষ দ্রষ্টব্য:

ন্তান মৃত্যুবরণ করার পর তার আকিকা দেওয়ার কোনো প্রমাণ হাদীসের কোথাও বর্ণিত হয়নি । তবে হ্যাঁ যদি তার ইছালে ছাওয়াবের উদ্দেশ্য দেওয়া হয় তাহলে সেটা ভিন্ন কথা ।

 

আকিকার জন্তুর ধরণ

 

যে পশু দিয়ে কোরবানি করা বৈধ সেই পশু দিয়ে আকিকা করা বৈধ । যে পশু দিয়ে কুরবানী করা জায়েয নয় সে পশু‌ দিয়ে আকিকা করাও বৈধ নয় । তাই আকিকার ক্ষেত্রে জন্তুর বয়সের দিক থেকে কোরবানির জন্তুর গুন পাওয়া যায় এমন পশু নির্বাচন করতে হবে । (জামে তিরমিজি ৪/১০১)

 

কোরবানির সঙ্গে আকিকা

 

কোরবানি পশুর সঙ্গে আকিকা করা বৈধ । একটি পশুতে তিন শরীক কোরবানি হলে সেখানে আরো দু- এক শরীক আকিকার জন্য দেওয়া যেতে পারে । তদ্রুপ কোরবানির মত একই পশুতে একাধিক ব্যক্তি শরিক হয়ে আকিকা আদায় করতে পারবে ।

 

 

আকিকার গোশত বন্টনের  নিয়ম

 

কোরবানির মত আকিকার পশুর গোশত ও তিন ভাগ করে এক- তৃতীয়াংশ ‌নিজের জন্য ।‌ এক তৃতীয়াংশ গরীব-মিসকিনদের জন্য সদকা করে দিয়ে বাকি এক-তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া সুন্নাত ।‌ অবশ্য পরিবারের সদস্য বেশি হলে ইচ্ছা করলে সব গোশত ও নিজেদের মধ্যে রেখে দেওয়া যায় ।

 

আকিকার গোশত সচ্ছল আত্মীয়স্বজনকে ও দেওয়া যায়। এখান থেকে আরেকটি বিষয় বোঝা গেল যে আকিকার গোশত আকিকাদাতা স্বয়ং যার জন্য আকিকা সে নিজে ও পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবাই আহার করতে পারবেন । কাঁচা গোস্ত হাদিয়া দিতে পারবেন। অথবা রান্না করে খাওয়াতে পারবেন ।

 

 

আকিকার পশুর চামড়া

 

কোরবানির মতোই আকিকার পশুর চামড়া গরিব মিসকিন কে দিয়ে দিবেন । বিভিন্ন প্রসেসিং করে নিজের ব্যবহার করতে পারবেন । কিন্তু বাজারে বিক্রি করলে বিক্রির টাকা তাদের মধ্যে বন্টন করে দিতে হবে । চামড়া বা চামড়ার মূল্য কোনটাই কসাইকে দেওয়া যাবে না ।

 

 

বিশেষ দ্রষ্টব্য:

আকিকার গোশত সবাই খেতে পারবে ।‌ এ নিয়ে অনেক কুসংস্কার সমাজে প্রচলিত আছে । সেগুলো থেকে সাবধান ।

 

 

আকিকার দোয়া

 

اللهم هذه عقيقة فلان……… دمها بدمه ولحمها بلحمه وعظمها بعظمه وجلدها بجلده وشعرها بشعره ….

اَللَّهُمَّ إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْض حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ – إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ – لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا اول مِنَ الْمُسْلِمِينَ – بِسْمِ اللهِ اَللهُ اكبر –

 

বাংলা উচ্চারণ:

আল্লাহুম্মা হাজিহি আকিকাতু ফুলানি ( এই স্থলে ছেলে বা কন্যার নাম উল্লেখ করবেন ) দামুহা বিদামিহি, ওয়া লাহমুহা বিলাহমিহি ,ওয়া আজমুহা বি আজমিহি ,ওয়া জিলদুহা বিজিলদিহি ,ওয়া শায়রুহা বি শায়রিহি ,

ইন্নি ওয়াঝঝাহতু ওয়াঝহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফা ওমা আনা মিনাল মুশরিকিন । ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন । লা শারিকালাহু ওয়া বি জালিকা উমিরতু ওয়া আনা আউয়ালু মিনাল মুসলিমিন । বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার ।

উল্লেখিত দোয়াটি না পারলেও সমস্যা নেই । কার জন্য আকিকা করা হচ্ছে তার খেয়াল অন্তরে রেখে এ দোয়াটি পড়ে জবাই করলেও হবে ।

 

بِسْمِ اللهِ اَللهُ اِكِبَر –

বাংলা উচ্চারণ: বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার ।

 

 

বিশেষ দ্রষ্টব্য:

আরবী দোয়ায় فلان এর স্থলে শিশুর নাম উচ্চারণ করবেন । কন্যা শিশু হইলে দোয়ার প্রথম শব্দ গুলো পরিবর্তন হয় এভাবে হবে-

بد مها. بلحمها . بعظ مها . بجلدها . بشعرها

 

লিখেছেন- মাওলানা শরিফ আহমাদ

 

 

 

 

 

 

 

Related Articles