ইসলাম

ঈদুল আজহা নামাজের নিয়ম ও নিয়ত। ঈদুল আযহার গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা মাওলানা শরিফ আহমাদ

সূচিপত্র

ঈদুল আজহা নামাজের নিয়ম ও নিয়ত

 

 

সুপ্রিয় পাঠক! আকাশে‌ জিলহজের চাঁদ উঠেছে। বছর ঘুরে আবার এলো ঈদ । পবিত্র ঈদুল আজহা । ঈদের আমেজ শহর-গ্রামে । ঘরে ঘরে খুশির কোলাহল । আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে ! তবে এই আনন্দের একটা সীমারেখা আছে । আনন্দ প্রকাশের ভাব-ভঙ্গিমা রয়েছে ‌। রয়েছে উত্তম তরীকা । ঈদের দিনের ইবাদতের মাঝে অন্যতম হলো ঈদুল আজহার নামাজ । কিন্তু অনেকেই এই নামাজের নিয়মকানুন সম্পর্কে জানে না । অনেকে জানার পর ও ভুলে গেছেন। তাই আজ এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো । পুরো লেখাটি পড়ুন ।

 

আরও পড়ুনঃ কুরবানীর ইতিহাস ও শিক্ষা 

 

ঈদুল আজহার উৎসব

ঈদুল আজহা
ঈদুল আজহা

ঈদুল আযহা তথা কুরবানীর ঈদ এসেছে। ঈদ সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক জাতির জন্য একটা ঈদের দিন আছে ,খুশির দিন আছে । আর এটা হল আমাদের দিন ,আমাদের খুশির দিন । আমাদের ঈদ বছরে দুটি ।

১. ঈদুল ফিতর ২.ঈদুল আযহা

আমাদের সামনে এখন হাজির পবিত্র ঈদুল আযহা ।

এই দিনে মুসলমানগন আনন্দ করেন । উৎসব করেন । এ উৎসব কিসের ? আর কেনই বা এত আনন্দ ! এ আনন্দ কুরবানীর আনন্দ । উৎসর্গ করার আনন্দ । শুধু ভোগে নয় ত্যাগেও আনন্দ আছে । মা বাবা নিজেদেরকে বঞ্চিত করে সন্তানকে খাইয়ে সাজিয়ে আনন্দ পায় । ত্যাগী মানুষেরা অপরকে বিলিয়ে দিয়েও আনাবিল আনন্দ লাভ করেন । ত্যাগেও আনন্দ অনুভব করেন । এ আনন্দের কোন তুলনা নেই। ইসলামই একমাত্র ধর্ম যার অনুসারীগণ প্রভুর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে জানমাল কুরবানী করে তৃপ্তি লাভ করেন । আনন্দ প্রকাশ করেন । তারা প্রমাণ করেছেন ত্যাগেই আনন্দ ।

আপনারা পড়ছেন – ঈদুল আজহা নামাজের নিয়ম ও নিয়ত

 

এই আনন্দের মাঝে কোন অহংকার নেই ৷ নেই কোন অহমিকা । বড়ত্ব নেই , নেই কোন দাম্ভিকতা । আছে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জান মাল উৎসর্গ করা আর আল্লাহর বড়ত্বের জয়গান । আছে শুধু তাকবীর ধ্বনি । আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা-

الله اكبر الله اكبر لا اله الا الله والله اكبر الله اكبر ولله الحمد

আল্লাহ সবচেয়ে বড় আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই ,আর আল্লাহর সবচেয়ে বড় আল্লাহ সবচেয়ে বড়, সকল প্রশংসা শুধু তারই ।

 

 

ঈদের দিনের ইবাদাত

 

ঈদুল আযহার দিনে অনেক ইবাদত রয়েছে । তার মাঝে প্রধান তিনটি । যেমন:

১. ঈদের নামাজ আদায় ।

২.তাকবীরে তাশরীকের পাঠ করা।

৩. কুরবানী করা ।

৪. আনন্দের মাঝেও দৈনন্দিন ইবাদত ঠিক রাখা ‌ ।

৫.নিজে খাওয়া ও অন্যদের মাঝে মিলিয়ে দেওয়া ।

 

 

ঈদের নামাজের বাইরের ফরজ

 

শুধু ঈদের নামাজের নয় বরং সকল নামাজের ভিতরের ফরজ ছয়টি । ধারাবাহিক ভাবে দিচ্ছি। খেয়াল করে পড়ুন । মুখস্ত কিংবা প্রয়োজনে নোট করুন ।

 

১. শরীর পাক

২.কাপড় পাক

৩. নামাজের জায়গা পাক

৪.সতর ঢাকা

৫. কেবলামুখী হওয়া

৬ ওয়াক্ত মত নামাজ পড়া ।

৭.নামাজের নিয়ত করা ।

 

ঈদের নামাজের ভেতরের ফরজ

 

১.তাকবীরে তাহরীমা বলা

২.খাড়া হয়ে নামাজ পড়া

৩.কেরাত পড়া

৪.রুকু করা

৫ দুই সিজদা করা

৬.আখেরি বৈঠক।

 

নামাজের ভিতরের এই ফরজ গুলো শুধু ঈদুল আযহা কিংবা ঈদুল ফিতরের জন্য নয়, এগুলো সব নামাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ।

 

 

ঈদের নামাজের স্থান

 

পুরো পৃথিবী নামাজের জন্য বৈধ স্থান বলে বিবেচিত হলেও ঈদুল আযহার নামাজের স্থান দুটি ।

১. ঈদগাহ ২. মহল্লার মসজিদ‌

ঈদের নামাজ খোলা মাঠে বা ঈদগাহে গিয়ে পড়া উত্তম ।‌ তবে বিশেষ কোনো প্রয়োজন মসজিদে ও আদায় করা যাবে ।

আর কোন ওজরবশত ১০ ই তারিখে এই নামাজ পড়তে না পারলে ১১ বা ১২ তারিখ পর্যন্ত ও পড়া যায় ।

তবে বিনা ওজরে ১০ ই তারিখে না পড়া মাকরুহ।

 

ঈদের নামাজ কার উপর ওয়াজিব

 

যেসব মুসলমানের উপর জুমার নামাজ ফরজ । তাদের উপর ঈদের নামাজ ওয়াজিব । যেমন:

১. প্রাপ্তবয়স্ক ২. সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন ৩. মুকীম ৪. মুসাফির ৫. সুস্থ ব্যক্তি ইত্যাদি।

 

মহিলাদের ঈদের নামাজের বিধান ‌

 

 

নারীদের উপর ঈদের নামাজ ওয়াজিব নয় । তারা ঈদের নামাজের জন্য ঈদগাহে যাবে না । তেমনি ভাবে নিজগৃহে নিজেরা জামাত করেও পড়বে না ।‌

হযরত নাফে রহ: বলেন আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার নারীদেরকে দুই ঈদে ঈদগাহে যেতে দিতেন না । (আল আওসাত ৪/৩০১)

অন্য আরেকটি বর্ণনা এসেছে , উরওয়া তার পিতা ( যুবাইর রা: ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি নিজ পরিবারের নারীদেরকে ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরে

যেতে দিতেন না ।

আপনারা পড়ছেন – ঈদুল আজহা নামাজের নিয়ম ও নিয়ত

 

( মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা, হাদীস নং ৫৮৪৬)

হযরত ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আল আনসারী রহ: বলেন,

আমাদের সময় দুই এদের জন্য যুবতী নারীদের বের হওয়ার প্রচলন ছিল না ।

(আল আওসাত ৪/৩০২; উমদাতুল কারী ৩/৩০৫)

হযরত ইব্রাহিম নাখায়ী বলেন, উভয় ঈদে মহিলাদের (নামাজের জন্য) বাইরে যাওয়া মাকরূহ ।

(মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৪/২৩৪)

 

মহিলাদের জন্য ঈদগাহে বা মসজিদে গিয়ে জামাতে নামায পড়া মাকরূহ। তবে যদি নামায পড়লে তা আদায় হয়ে যাবে। নারীদের আসল স্থান হল তাদের বসবাসের ঘর। নারীদের মসজিদে এসে নামায পড়া রাসূল সাঃ পছন্দ করতেন না। তবে যেহেতু রাসূল সাঃ সবার নবী। আর রাসূল সাঃ এর কাছে ওহী নাজিল হতো। তাই নারীরা রাসূল সাঃ এর জমানায় ওহীর বানী শুনার জন্য মসজিদে আসতো। এটি ছিল শুধুই প্রয়োজনের তাগিতে। যে প্রয়োজন রাসূল সাঃ ইন্তেকালের দ্বারা বন্ধ হয়ে গেছে।

 

তাছাড়া বর্তমানে ফেতনা ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই যুগে কোন ভাবেই মসজিদে যাওয়া তাদের জন্য

উচিত নয়। একটি হাদীস দেখুন।

হযরত আমরাতা বিনতে আবদির রহমান বলেন-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহধর্মীনী হযরত আয়শা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহা বলেছেন-যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদের এখনকার অবস্থা জানতেন, তারা কি করে? তাহলে তাদের মসজিদে আসতে নিষেধ করতেন যেভাবে বনী ইসরাঈলের মহিলাদের নিষেধ করা হয়েছে।

 

 

ইয়াহইয়া বলেন-আমি আমরাতাকে বললাম-বনী ইসরাঈলের মহিলাদের কি মসজিদে আসতে নিষেধ করা হয়েছে? তিনি বললেন-হ্যাঁ।

(সহীহ মুসলিম -১/১৮৩, হাদীস নং-১০২৭

সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৫৬৯

মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২৫৯৮২

মুসনাদুর রাবী, হাদীস নং-২৫৯

সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-৫৪০ )

আর একটি হাদীস দেখুন। এটার মাধ্যমে এই প্রসঙ্গ ইতি টানবো ।

হযরত আবু আমর বিন শায়বানী থেকে বর্ণিত। তিনি দেখেছেন-হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু মহিলাদের মসজিদে থেকে বের করে দিতেন। আর বলতেন যে, মসজিদের চেয়ে তোমাদের জন্য ঘরই উত্তম। মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদীস নং-৫২০১,মুসান্নাফে ইবনুল জি’দ, হাদীস নং-৪২৯

সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদীস নং-৫৪৪১

আল মুজামুল কাবীর, হাদীস নং-৯৪৭৫)

 

 

ঈদের নামাজের সময় ‌

 

সকালে সূর্য ওঠা থেকে শুরু করে ঈদের নামাজের ওয়াক্ত হয়ে থাকে। জোহরের আগেই এ নামাজ পড়তে হবে । তবে এতো বিলম্ব কোথাও করা হয় না । করা উচিত ও নয় । পবিত্র ঈদুল ফিতর দেরিতে পড়া হলে ও পবিত্র ঈদুল আজহা দ্রুত পড়া উচিত।

কেননা এই ঈদের পরে কুরবানীর আমল আছে ।

এটি সম্পাদন করতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। তাই ঈদুল আজহার নামাজ সকাল সকাল আদায় করা হলে

পরবর্তী কুরবানী জলদি সমাপ্ত হবে ।

কুরবানীর প্রথম গোস্ত দ্বারা সাময়িক রোজাও ভঙ্গ করা যাবে । সকলে এ বিষয়ে আরো সতর্ক হতে পারেন।

 

 

ঈদের নামাজে ছয় তাকবীরের দলীল

 

ঈদের নামাজে ছয় তাকবীর হবে নাকি ১২ তাকবীর হবে এ নিয়ে তর্ক বেশ পুরনো । এশিয়া মহাদেশে হানাফী মাযহাব অবলম্বী অধিকাংশ মানুষ । সহীহ হাদীস এবং হানাফী মাযহাবের আলোকে ছয় তাকবীর পড়ার নিয়ম এবং সংক্ষেপে দুটি দলীল পেশ করা হলো ।

 

ঈদের নামাজে তাকবীর বলার নিয়ম

 

৬ তাকবীরের ক্ষেত্রে প্রথম রাকাতের শুরুতে অতিরিক্ত তিন তাকবীর এবং দ্বিতীয় রাকাতে অতিরিক্ত তিন তাকবীর দিতে হয় ।‌ প্রথম রাকাতের সানা পাঠের পর কানের লতি পর্যন্ত হাত তুলে পরপর তিন তাকবীর বলতে হয় ।

দ্বিতীয় রাকাতে সূরা পাঠ শেষ করে রুকুতে যাওয়ার আগে অতিরিক্ত তিন তাকবীর বলতে হয় ।‌ অতিরিক্ত তাকবীর বলার পর কানের লতি থেকে হাত নামিয়ে আনতে হয় ।

 

ঈদের নামাজে ছয় তাকবীরের দলীল

 

১ নং দলীল

عن الثوري، عن أبي إسحاق، عن علقمة والأسود بن يزيد، أن ابن مسعود كان يكبر في العيدين تسعاً تسعاً : أربعاً قبل القراءة، ثم كبر فركع، وفي الثانية يقرأ، فإذا فرغ كبر أربعاً ثم ركع.

 

অর্থ: ইমাম আবদুর রায্যাক রাহ. (সুফিয়ান) ছাওরী থেকে, তিনি আবু ইসহাক থেকে, তিনি আলকামা ও আসওয়াদ ইবনে ইয়াযিদ থেকে, তাঁরা ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি (ইবনে মাসউদ রা.) দুই ঈদের নামাযে ৯টি করে তাকবীর দিতেন। কুরআন পাঠের আগে ৪টি। তারপর তাকবীর দিয়ে রুকু করতেন। দ্বিতীয় রাকাতে দাঁড়িয়ে কুরআন পড়তেন। কুরআন পড়া শেষ হলে ৪ তাকবীর দিতেন। তারপর রুকু করতেন। ( মুসান্নাফে আবদুর রায্যাক, বর্ণনা ৫৬৮৬ )

আপনারা পড়ছেন – ঈদুল আজহা নামাজের নিয়ম ও নিয়ত

২ নং দলীল

 

حدثنا إبراهيم بن مرزوق قال : ثنا عبد الصمد بن عبد الوارث قال: ثنا شعبة قال : ثنا قتادة وخالد الحذاء، عن عبد الله بن الحارث أنه صلى خلف ابن عباس رضي الله عنهما في العيد،  فكبر أربعاً ثم قرأ، ثم كبر فركع، ثم قام في الثانية فقرأ، ثم كبر ثلاثاً، ثم كبر فركع

 

অর্থ: ইমাম তহাবী রাহ. ইবরাহীম ইবনে মারযূক থেকে, তিনি আবদুস সামাদ ইবনে আবদুল ওয়ারিছ থেকে, তিনি শুবা থেকে,তিনি কাতাদা ও খালিদ (ইবনে মেহরান) আলহায্যা থেকে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে হারিছ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি ইবনে আব্বাস রা.-এর পেছনে ঈদের নামায পড়তে গিয়ে লক্ষ করেছেন, তিনি ৪ তাকবীর দিয়ে কুরআন পড়েছেন। তারপর তাকবীর দিয়ে রুকু করেছেন। দ্বিতীয় রাকাতে দাঁড়িয়ে কুরআন পড়ে ৩ তাকবীর দিয়েছেন। তারপর তাকবীর দিয়ে রুকু করেছেন। (শরহু মাআনিল আছার ৪/৫৭০)

 

 

ঈদুল আজহার নামাজের আরবী নিয়ত

نويت ان اصلي لله تعالى ركعتي الواجب صلاة عيد الاضحى مع سته تكبيرات واجبات.

 

ঈদুল আজহার নামাজের নিয়ত উচ্চারণ

নাওয়াইতু আন উসল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা রাকআতাল ওয়াজিবি মাআ সিত্তাতি তাকবীরাত ।‌ ইক্তাদাইতু বি-হাজাল ইমাম মুতাওজ্জিহান ইলা জিহাতি কায়বাতিশ শরীফাতি আল্লাহু আকবার ।

 

 ঈদের নামাজ সহ অন্য সকল নামাজের আরবী নিয়ত করা জরুরী নয় । নিজস্ব ভাষায় নিয়ত করলে হয়ে যাবে । তাই আরবী নিয়ত শেখার প্রতি অত গুরুত্ব না দিয়ে অন্য সূরা কালাম শেখার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত ।

 

ঈদুল আজহার নামাজের বাংলা নিয়ত

আমি ঈদুল আজহার দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ ৬ তাকবীরের সাথে এই ইমামের পিছনে আদায় করছি- আল্লাহু আকবার ।

 

 

ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করার নিয়ম

ঈদুল আজহার নামাজ পড়ার নিয়ম
ঈদুল আজহার নামাজ পড়ার নিয়ম

 

ঈদের নামাজের জন্য প্রথমে নিয়ত করে নিবেন । আর নিয়তটি সংক্ষেপে এভাবে – আমি ঈদুল আজহার দু’রাকাত নামাজ অতিরিক্ত ৬ তাকবীরের সাথে ইমামের পিছনে আদায় করছি ।

নিয়ত করার পর অন্যান্য নামাজের মত তাকবীরে তাহরীমা অর্থাৎ আল্লাহু আকবার বলে হাত বেধে ছানা পড়বেন । সানার পর অতিরিক্ত তিন তাকবীর দিবেন‌ ।প্রথম তাকবীর বলার সময় উভয় হাত কানের লতি পর্যন্ত উঠাবেন এবং তাকবীর শেষে হাত না বেঁধে ছেড়ে দিবেন। তিন বার সুবহানাল্লাহ বলা যায় এ পরিমাণ সময় বিলম্ব করে উভয় হাত কানের লতি পর্যন্ত উঠিয়ে দ্বিতীয়বার তাকবীর দিবেন ।

তারপর হাত ছেড়ে দিবেন । এবারও ওই পরিমাণ বিলম্ব করে আবার তাকবীর দিবেন । তারপর হাত না ছেড়ে বেঁধে নিবেন । এবার ইমাম সাহেব যথানিয়মে আউযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ পড়ে সূরা ফাতিহা পড়বেন এবং অন্য একটি সূরা মিলাবেন । আর মুক্তাদীগণ চুপ করে থাকবেন । শুধু মনোযোগ দিয়ে শুনবেন । তারপর যথানিয়মে ইমাম তাকবীর দিয়ে রুকুতে যাবেন এবং রুকু সিজদা সমাপ্ত করে দ্বিতীয় রাকাতের জন্য উঠে দাঁড়াবেন ।

দ্বিতীয় রাকাতে ইমাম সাহেব সূরা ফাতিহার সাথে অন্য একটি সূরা পড়বেন । আর মুক্তাদীগণ চুপ করে থাকবেন । খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবেন । ইমামের কেরাত সমাপ্ত হওয়ার পর রুকুতে যাওয়ার আগে পূর্বের নিয়মে ইমামের সাথে তিনটি অতিরিক্ত তাকবীর দিবেন ।

এবং প্রতিবার তাকবীরে তাহরীমাই হাত ছেড়ে দিবেন। এরপর চতুর্থ তাকবীর দিয়ে ইমামের সাথে রুকুতে যাবেন । নামাজের অন্যান্য তাকবীরের মত অতিরিক্ত ছয় তাকবীর ইমাম-মুক্তাদী উভয়ে দিবেন ।তবে ইমাম উচ্চস্বরে আর মুক্তাদীগণ অনুচ্চস্বরে তাকবীর দিবেন ।এরপর যথা নিয়মে নামাজ শেষ করবেন । এবং নামাযের পর খুতবা শুনবেন । খুতবা শোনা ওয়াজিব ।

 

ঈদুল আজহার নামাজ কি ?

 

ঈদুল আযহার দিনে মুসলমানদের একত্র হয়ে শোকর আদায়ের জন্য দুই রাকাত নামাজ পড়া হয় তাকে ঈদুল আযহার নামাজ বলে ।

 

ঈদুল আজহার মাসআলা

 

* ঈদুল আজহার দুই রাকাত নামাজ ওয়াজিব ।

*এই দুই রাকাতের অতিরিক্ত ছয়টি তাকবীর বলা ওয়াজিব ।

* খুতবা ব্যতীত জুমার নামাজের জন্য যেসব শর্ত ঈদের নামাজের জন্য সেসব শর্ত ।

* ঈদের নামাজে প্রথম রাকাতে সূরা আলা এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা গাসিয়া পড়া উত্তম ।

 

ঈদুল আযহার খুতবা ও তখনকার আমল

 

 

* ঈদুল আযহার দুই খুতবা পাঠ করা সুন্নাত।

*এই খুতবা নামাজের পরে হওয়া সুন্নাত ।

* এই খুতবা মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে পাঠ করা সুন্নাত ।

* দুই খুতবার মাঝখানে জুম্মার ন্যায় দুইবার কিছুক্ষণ বসার সুন্নাত ।

* এই খুতবা শোনা ওয়াজিব যেমন জুমার খুতবা শোনা ওয়াজিব। দূরত্বের কারণে খুতবা না শুনতে পেলে চুপ করে কান লাগিয়ে থাকা ওয়াজিব ।

 

 

ঈদুল আযহার খুতবার মধ্যে যেসব বিষয় থাকবে

 

জুমার খুতবার মধ্যে যেসব বিষয় থাকবে ঈদের খুতবার মধ্যেও সেসব বিষয় থাকবে । পার্থক্য শুধু এই যে মেম্বারে ওঠে না বসেই ঈদের খুতবা শুরু করা সুন্নাত । এবং ঈদুল আযহার খুতবায় কুরবানী ও তাকবীরে তাশরীক এর বিধান বর্ণনা করতে হবে । আর তাকবীর আল্লাহু আকবার বলে ঈদের খুতবা আরম্ভ করা সুন্নাত । প্রথম খুতবার শুরুতে তাকবীর নয়বার একাধারে এবং দ্বিতীয় খুতবার শুরুতে ৭ বার একাধারে বলা । আর সব শেষে মেম্বার থেকে অবতরণের সময় চোদ্দৌবার একাধারে বলা মুস্তাহাব ।

 

ঈদের নামাজের পরের আমল

 

ঈদের নামাজের পর খুতবার পড়ে দোয়া-মুনাজাত করা যদিও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাবেঈন ও তাবে তাবেঈন থেকে বর্ণিত প্রমাণিত নয় কিন্তু অন্যান্য নামাজের পর যেহেতু দোয়া করা সুন্নাত তাই ঈদের নামাজের পরও দোয়া করা সুন্নাত । খুতবার পর কিংবা নামাজের পরও দোয়া করা যেতে পারে বলে যুক্তি পেশ করেছেন আহসানুল ফতোয়ার গ্রান্থাকার ।

 

তাকবীরে তাশরীক

اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ وَلِلَّهِ الْحَمْدُ

 

 

তাকবীরে তাশরীকের বাংলা উচ্চারণ:

 

আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার,লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ও আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ও লিল্লাহিল হামদ ।

 

তাকবীরে তাশরীকের অর্থ:

 

আল্লাহ সবচেয়ে বড় আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই । আর আল্লাহ সবচেয়ে বড় আল্লাহ সবচেয়ে বড়, সকল প্রশংসা শুধু তারই ।

 

 

তাকবীরে তাশরীকের বিধান

 

 

জিলহজ্ব মাসের ১০–১২ তারিখ থেকে কুরবানীর আমল যেমন ওয়াজিব তেমনি তাকবীরে তাশরীক অর্থাৎ জিলহজ মাসের ৯ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের সালাম ফিরানোর পর পুরুষদের জন্য উচ্চস্বরে এবং মহিলাদের জন্য নিম্নস্বরে একবার তাকবীরে তাশরিক পড়া ওয়াজিব । কোথাও কোথাও তিনবার পড়ার প্রচলনও আছে।

 

 

ঈদের খুতবা শোনার দলীল

 

 

ঈদের বা জুমার খুৎবা শুনা আবশ্যক হওয়া মর্মে অনেক প্রমাণ আছে। এর মাঝে কয়েকটি হাদীস উপস্থাপন করছি।

 

১ নং দলীলঃ

হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-যখন তুমি তোমার পাশের জনকে জুমআর দিন বল-চুপ থাক এমতাবস্থায় যে, ইমাম সাহেব খুতবা দিচ্ছে, তাহলে তুমি অযথা কাজ করলে। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৮৯২, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২০০৫)

 

২ নং দলীলঃ

 

হযরত জাবির রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু মসজিদে প্রবেশ করলেন এমতাবস্থায় যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুতবা দিচ্ছিলেন। তখন তিনি হযরত উবাই বিন কাব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর পাশে এসে বসলেন। বসে উবাইকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন বা কোন বিষয়ে কথা বললেন।

কিন্তু উবাই তার কথার কোন প্রতিউত্তর করলেন না। তখন ইবনে মাসঊদ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু মনে করলেন তিনি হয়তো তার উপর রাগাম্বিত। তারপর যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষ করে চলে গেলেন। তখন ইবনে মাসঊদ বললেন, হে উবাই! আমার কথা জবাব দিতে তোমাকে বাঁধা দিল কে?

তিনি বললেন, তুমি আমাদের সাথে জুমআর নামাযে উপস্থিত হওনি। ইবনে মাসঊদ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বললেন, তো? উবাই রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু ‌বললেন, তুমি কথা বলছিলে আর রাসূল সাল্লাল্লাহু‌ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো তখন খুতবা দিচ্ছিলেন। (তাই কথার জবাব দেইনি) একথা শুনে আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ দাড়িয়ে গেলেন ।

ছুটে গেলেন রাসূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এর কাছে। জানালেন পুরো বিষয়টি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু‌ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, উবাই ঠিক কথাই বলেছে। তুমি এ বিষয়ে উবাই এর কথাকে মেনে নাও। (মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদীস নং-১৭৯৯)

 

 

ঈদের দিনে কি জুমা পড়তে হয় না ?

 

 

 

আবু দাউদসহ কিছু হাদীসের কিতাবে একথা আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের নামাযের পর জুমআর নামায পড়াকে ইচ্ছাধীন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু তিনি নিজে ঈদের নামাযের পর জুমআর নামায পড়েননি একথা কোন হাদীসে আসেনি।

 

ফুক্বাহায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঈদের দিন জুমআর নামায ইচ্ছাধীন হওয়ার সুযোগ দেয়ার ব্যাখ্যায় বলেন যে, মূলত ঈদের দিন গ্রামাঞ্চল থেকে লোকজন মদীনায় এসে রাসূল সাঃ এর সাথে ঈদের নামাযে শরীক হতো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূলত তাদের বলেছেন যে, তোমাদের ইচ্ছে, জুমআর নামায পড়েও গ্রামে ফিরতে পার, কিংবা এর আগেও ফিরতে পার। কারণ গ্রামে জুমআর নামায পড়া জায়েজ নেই। এ কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সুযোগ তাদের জন্য দিয়েছেন। এটা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যদি সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতো, তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে জুমআ পড়তেন না। অথচ জুমআর নামায আবশ্যক হবার পর থেকে জুমআর দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমআর নামায পড়েননি এমন কোন বর্ণনা কোথাও নেই। তাই ঈদের দিনও জুমআর নামায পড়া আবশ্যক।

 

আপনারা পড়ছেন – ঈদুল আজহা নামাজের নিয়ম ও নিয়ত

তাহলে বুঝা গেল, উক্ত হাদীস দ্বারা উদ্দেশ্য হল, এমন গ্রামের মুসল্লি যে গ্রামে জুমআর নামায আবশ্যক নয়। কিন্তু তারা ঈদের নামায পড়ার জন্য শহরে এল। তাদের জন্য রাসূল সাঃ উক্ত নির্দেশনাটি দিয়েছেন। শহরবাসী তথা যেখানে জুমআ পড়া আবশ্যক সে এলাকার জন্য উক্ত নির্দেশনা প্রযোজ্য নয়। (ফাতওয়া শামী-২/১৬৬

বাদায়েউস সানায়ে-১/২৭৫)

 

 

ঈদের নামাজের ইমামের বেতন নির্ধারণ

 

 

ঈদের নামাজের জন্য ইমামের বেতন নির্ধারণ করা যাবে । যেহেতু ঈদের নামায শেয়ারে ইসলাম তথা ইসলামের প্রতীক। এটি একটি আবশ্যকীয় ইবাদত। তা’ই এটি আদায়ের জন্য কাউকে বেতনভূক্ত হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা সম্পূর্ণ জায়েজ।

সুযোগ সুবিধা বেশি পেলে, আর ইমাম সাহেবের ব্যক্তিগত প্রয়োজন বেশি হলে তিনি প্রয়োজনে ঈদগাহ পরিবর্তনও করতে পারেন। এতে দোষণীয় কিছু নেই।

 

 

ঈদুল আজহার সুন্নাত

 

১.অন্যদিনের তুলনায় সকালে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। (বায়হাকী, হাদীস নং-৬১২৬)

২.মিসওয়াক করা। (তাবয়ীনুল হাকায়েক-১/৫৩৮)

৩.গোসল করা। (ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৩১৫)

 

৪.শরীয়তসম্মত সাজসজ্জা করা। (বুখারী, হাদীস নং-৯৪৮)

৫.সামর্থ অনুপাতে উত্তম পোশাক পরিধান করা। (বুখারী, হাদীস নং-৯৪৮, মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস নং  -৭৫৬০)

৬.সুগন্ধি ব্যবহার করা। ( মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস নং-৭৫৬০)

৭.ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাবার আগে মিষ্টি জাতীয় যেমন খেজুর ইত্যাদি খাওয়া। তবে ঈদুল আযহাতে কিছু না খেয়ে ঈদের নামাযের পর নিজের কুরবানীর গোশত আহার করা উত্তম। (বুখারী, হাদীস নং-৯৫৩, তিরমিজী, হাদীস নং-৫৪২, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-১৬০৩)

৮.সকাল সকাল ঈদগাহে যাওয়া। (আবু দাউদ, হাদীস নং-১১৫৭)

৯.ঈদুল ফিতরে ঈদগাতে যাওয়ার পূর্বে সদকায়ে ফিতর আদায় করা। (দারাকুতনী, হাদীস নং-১৬৯৪)

১০.ঈদের নামায ঈদগাহে আদায় করা, বিনা অপরাগতায় মসজিদে আদায় না করা। (বুখারী, হাদীস নং-৯৫৬, আবু দাউদ, হাদীস নং-১১৫৮)

১১.যে রাস্তায় ঈদগাতে যাবে, সম্ভব হলে ফিরার সময় অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরা। (বুখারী, হাদীস নং-৯৮৬)

 

১২.পায়ে হেটে যাওয়া। (আবু দাউদ, হাদীস নং-১১৪৩)

 

১৩.ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাবার সময় আস্তে আসত্ এই তাকবীর পড়তে থাকাঃ

اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ وَلِلَّهِ الْحَمْدُ

 

১৪ নং হাদীসতবে ঈদুল আযহায় যাবার সময় পথে এ তাকবীর আওয়াজ করে পড়তে থাকবে। (মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস নং-১১০৫) (কিতাবুস সুন্নাহ, মুফতী মনসূরুল হক হা: )

 

 

 

লিখেছেন: মাওলানা শরিফ আহমাদ

ঢাকা, বাংলাদেশ ।

আমাদের সাথে ফেসবুকে যুক্ত হোন

দৈনিক শিক্ষা নিউজ

 

Related Articles