ইসলাম

কুরবানীর ইতিহাস ও শিক্ষা মাওলানা শরিফ আহমাদ

কুরবানীর ইতিহাস ও শিক্ষা

সুপ্রিয় পাঠক বন্ধুরা । গত বৃহস্পতিবার রাতে আকাশে ঈদুল আযহা চাঁদ উঠেছে ‌। আলহামদুলিল্লাহ । ১০ ই জিলহজ অর্থাৎ ১০ জুলাই রবিবার হচ্ছে ঈদুল আযহা । ঈদকে ঘিরে চলছে নানা আয়োজন। চলছে হরেক প্রস্তুতি। মসজিদে মসজিদে হচ্ছে কোরবানির ইতিহাস ও শিক্ষা নিয়ে আলোচনা । অনেকেই দলীল ভিত্তিক কলাম সার্চ করছেন । তাই আপনাদের জন্য আজকের এই আয়োজন । পড়ুন। উপকৃত হলে ধন্য হবো ।

 

পৃথিবীতে কুরবানীর সূচনা

 

কুরবানির প্রথা মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম আলাইহিস সালামের দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল । হাবিল কাবিলের কুরবানী মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কুরবানী । মহান আল্লাহ তা’আলা আদম আলাইহিস সালামের পুত্রদের কুরবানীর কাহিনী পবিত্র কুরআনুল কারীমের বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন । এবং প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ ঘটনা উম্মতের নিকট যথাযথভাবে বর্ণনা করার নির্দেশ প্রদান করেছেন ।

 

 

এবং তিনি বর্ণনাও করেছেন। সে বর্ণনাগুলো ধারাবাহিক ভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে।

 

হাবিল কাবিলের কুরবানী

 

বিভিন্ন কিতাবে বর্ণিত আছে হযরত আদম আলাইহিস এবং হাওয়া আলাইহিস সালাম যখন দুনিয়ায় আগমন করেন এবং সন্তান প্রজনন ও বংশবিস্তার আরম্ভ হয় , তখন প্রতি গর্ভ থেকে একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করতো । পর্যায়ক্রমে হযরত হাওয়া আলাইহিস সালামের ২০ গর্ভে ৪০ জন বা ১২০ গর্ভে ২৪০ জন ছেলেমেয়ে জন্মগ্রহণ করেন বলে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায় ।

 

তখন হযরত আদম আলাইহিস সালামের সন্তান ব্যতীত যেহেতু অন্য কোন মানুষের ছিল না তাই আল্লাহ তা’আলা উপস্থিত প্রয়োজনের খাতিরে আদম আলাইহিস সালামের শরীয়তের বিশেষভাবে নির্দেশ জারি করেন যে একই গর্ব থেকে যে জমজ পুত্র ও কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করবে তারা পরস্পর ভাই বোন বলে গণ্য হবে । তাদের মধ্যে বিবাহের সম্পর্ক হারাম হবে ।

 

 

পক্ষান্তরে পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারী কন্যা প্রথম গর্ব থেকে জন্মগ্রহণকারী ছেলের জন্য বোন বলে গণ্য হবে না । একইভাবে প্রথম গর্ভে জন্মগ্রহণকারী পুত্রের জন্য পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারী কন্যা সহোদরা বোন বলে গণ্য হবে না । তাই এদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক বৈধ হবে ।

 

 

কিন্তু ঘটনাক্রমে কাবিলের সহজাত সহোদরা বোন ছিল পরমাসুন্দরী এবং হাবিলের সহজাত বোন ছিল অসুন্দর। বিবাহের সময় হলে নিয়ম অনুযায়ী হাবিলের জমজ কালো কন্যা কাবিলের ভাগে পড়ে । এতে কাবিল অসন্তুষ্ট হয়ে হাবিলের শত্রু হয়ে যায় । এবং সে জেদ ধরে যে আমার যমজ বোনকে আমার সঙ্গে বিবাহ দিতে হবে । হযরত আদম আলাইহিস সালাম তার শরীয়তের নিয়ম অনুযায়ী কাবিলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন ।

 

এবং উভয়ের মতভেদ দূর করার জন্য বললেন তোমরা আল্লাহর জন্য নিজ নিজ কোরবানি পেশ করো । যার কোরবানি গৃহীত হবে সেই উক্ত কন্যাকে বিয়ে করবে ।
তৎকালীন সময়ে কোরবানি গৃহীত হওয়ার আলামত ছিল আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে কোরবানীকে ভস্মিভূত করে আবার অন্তর্হিত হয়ে যাওয়া । আর যে কোরবানিকে আগুন স্পর্শ করত না বা জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করত না তা প্রত্যাখ্যাত বলে মনে করা হতো ‌ । হাবিল ভেড়া দুম্বা ইত্যাদি পশু পালন করত ।

 

 

তাই সে একটি উন্নত মানের দুম্বা কোরবানির জন্য পেশ করল । আর কাবিল কৃষি কাজ করত তাই সে কিছু শস্য,গম ইত্যাদি পেশ করল ।‌ আসমান থেকে নিয়ম অনুযায়ী অগ্নিশিখা নেমে এলো ‌। এবং হাবিলের কুরবানীটি জ্বালিয়ে দিয়ে অন্তর্হিত হয়ে গেল আর কাবিলের কোরবানি যেমন ছিল তেমনি জমিনে পড়ে রইল ।

 

 

এ অকৃতকার্যতায় তার দুঃখ-ক্ষোভ বেড়ে গেল এবং আত্ম সংবরণ করতে না পেরে সে ভাইকে প্রকাশ্য বলে দিল আমি তোমাকে খুন করবো । হাবিল মার্জিত আকারে একটি নীতি কথা বললেন- قال انما يتقبل الله من المتقين অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা তো কেবল খোদাভীরু ও পরহেজগারদের কর্ম গ্রহণ করেন ।

 

কুরআনে‌ হাবিল কাবিলের ঘটনা

 

মহান আল্লাহ তা’আলা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে লক্ষ বলেছেন-

وَاتۡلُ عَلَیۡہِمۡ نَبَاَ ابۡنَیۡ اٰدَمَ بِالۡحَقِّ ۘ اِذۡ قَرَّبَا قُرۡبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنۡ اَحَدِہِمَا وَلَمۡ یُتَقَبَّلۡ مِنَ الۡاٰخَرِ ؕ قَالَ لَاَقۡتُلَنَّکَ ؕ قَالَ اِنَّمَا یَتَقَبَّلُ اللّٰہُ مِنَ الۡمُتَّقِیۡنَ
অনুবাদ:আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের বাস্তব অবস্থা পাঠ করে শুনান। যখন তারা ভয়েই কিছু উৎসর্গ নিবেদন করেছিল, তখন তাদের একজনের উৎসর্গ গৃহীত হয়েছিল এবং অপরজনের গৃহীত হয়নি।

 

 

সে বললঃ আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। সে বললঃ আল্লাহ ধর্মভীরুদের পক্ষ থেকেই তো গ্রহণ করেন।(আল মায়িদাহ – ২৭)

لَئِنۡۢ بَسَطۡتَّ اِلَیَّ یَدَکَ لِتَقۡتُلَنِیۡ مَاۤ اَنَا بِبَاسِطٍ یَّدِیَ اِلَیۡکَ لِاَقۡتُلَکَ ۚ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اللّٰہَ رَبَّ الۡعٰلَمِیۡنَ
অনুবাদ:যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হস্ত প্রসারিত কর, তবে আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার দিকে হস্ত প্রসারিত করব না। কেননা, আমি বিশ্বজগতের পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করি।(আল মায়িদাহ – ২৮)

 

 

اِنِّیۡۤ اُرِیۡدُ اَنۡ تَبُوۡٓاَ بِاِثۡمِیۡ وَاِثۡمِکَ فَتَکُوۡنَ مِنۡ اَصۡحٰبِ النَّارِ ۚ  وَذٰلِکَ جَزٰٓؤُا الظّٰلِمِیۡنَ ۚ
অনুবাদ: আমি চাই যে, আমার পাপ ও তোমার পাপ তুমি নিজের মাথায় চাপিয়ে নাও। অতঃপর তুমি দোযখীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাও। এটাই অত্যাচারীদের শাস্তি।(আল মায়িদাহ – ২৯)

فَطَوَّعَتۡ لَہٗ نَفۡسُہٗ قَتۡلَ اَخِیۡہِ فَقَتَلَہٗ فَاَصۡبَحَ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ
অনুবাদ:অতঃপর তার অন্তর তাকে ভ্রাতৃহত্যায় উদুদ্ধ করল। অনন্তর সে তাকে হত্যা করল। ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। (আল মায়িদাহ – ৩০)

فَبَعَثَ اللّٰہُ غُرَابًا یَّبۡحَثُ فِی الۡاَرۡضِ لِیُرِیَہٗ کَیۡفَ یُوَارِیۡ سَوۡءَۃَ اَخِیۡہِ ؕ  قَالَ یٰوَیۡلَتٰۤی اَعَجَزۡتُ اَنۡ اَکُوۡنَ مِثۡلَ ہٰذَا الۡغُرَابِ فَاُوَارِیَ سَوۡءَۃَ اَخِیۡ ۚ  فَاَصۡبَحَ مِنَ النّٰدِمِیۡنَ ۚۛۙ

অনুবাদ:আল্লাহ এক কাক প্রেরণ করলেন। সে মাটি খনন করছিল যাতে তাকে শিক্ষা দেয় যে, আপন ভ্রাতার মৃতদেহ কিভাবে আবৃত করবে। সে বললঃ আফসোস, আমি কি এ কাকের সমতুল্যও হতে পারলাম না যে, আপন ভ্রাতার মৃতদেহ আবৃত করি। অতঃপর সে অনুতাপ করতে লাগল। (আল মায়িদাহ – ৩১)

 

কুরবানীর ইতিহাস ও শিক্ষা 

কুরবানীর ইতিহাস ও শিক্ষা
কুরবানীর ইতিহাস ও শিক্ষা

জাহেলী যুগে প্রতি বছরই এক মৌসুমে নীল নদের পানি শুকিয়ে যেত । আর মিশরের নীল নদই হল সেদেশের কৃষি ব্যবস্থার প্রাণ ।‌ তাই প্রতিবছরই যখন পানি শুকিয়ে যেত । প্লাবন না আসতো তখন মিশরের অধিবাসীরা একটি ষোড়শী সুন্দরী মেয়েকে নববধূর সাজে সজ্জিত করে নীলনদে বলি দিত। এরপর তাতে প্লাবন আসতো । খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফত আমলে মিশর মুসলমানদের কর্তালগত হয় ।

 

 

হযরত ওমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন মিশর বিজয়ী সেনাপতি এবং তাকেই মিশরের গভর্নর নিয়োগ করা হয়েছিল । ঘটনা ক্রমে ওই বছরও নির্দিষ্ট সময় নীল নদে প্লাবন আসলো না । মিশরবাসি জাহিলিয়াতের প্রথা অনুযায়ী একটি ষোড়শী কন্যাকে নীল নদে বলি দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করলো ।

 

হযরত ওমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু এর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বললেন এ ব্যাপারে আমিরুল মুমিনিন কে অবহিত করব এবং তার নির্দেশ মোতাবেক কাজ হবে ।
হযরত ওমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু বিষয়টি হযরত ওমর রাদিআল্লাহু আনহুকে জানালেন । তিনি নীল নদের নামে একটি পত্র লিখলেন- হে নীলনদ ! যদি তুমি আল্লাহ তালার হুকুমে পরিচালিত হয়ে থাকো তবে আমি রাসূলুল্লাহর খলিফা নির্দেশ দিচ্ছি তুমি প্লাবিত হও ।

 

 

কিন্তু যদি তুমি শয়তানের কথায় পরিচালিত হও তবে তোমার পানি আমাদের কোন প্রয়োজন নেই । আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য যথেষ্ট । হযরত আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু এ চিঠি পাওয়ার পর জনসাধারণের মধ্যে ঘোষণা দিলেন। অমুক দিন অমুক সময় খলিফা চিঠি নীল নদে দেয়া হবে । এ সংবাদ প্রচার হওয়ার পর মিশরবাসীর কৌতুহলের কোন সীমা রইল না ।

 

বিস্ময়কর এ দৃশ্য দেখার জন্য নির্দিষ্ট সময় লাখো জনতা সমবেত হলো । সকলের সামনে খলিফার পত্র নীল নদে ফেলা হলো ।
আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে সঙ্গে সঙ্গে নীল নদে প্লাবন আসলো । বর্ণিত আছে যে সেদিন ১৬ হাত উঁচু হয়ে প্লাবন এসেছিল । এরপর আজ পর্যন্ত আর কখনো নীলনদের পানে ধারা বন্ধ হয়নি । আর এভাবেই বন্ধ হল যুগ যুগ ধরে চলে আসা দেবদেবীদের নামে মানুষ বলি দেওয়ার প্রথা।

 

নোট: আমাদের বাংলাদেশ ভূখণ্ডেও নরবলির নিদর্শন রয়েছে । সিলেট জেলার উত্তর-পূর্বক কোণে খাসিয়া জয়ন্তিয়া রাজ্যের  রাজবাড়ীতে এখনো যে বৃহৎ পাথরের উপর যে নরবলি দেওয়া হতো রক্ত প্রবাহিত হওয়ার পাথরের নালা সহ তা আজও বিদ্যমান রয়েছে। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশ কামরূপ কামাখ্যার মধ্যেও অসংখ্য মানুষ বলি দেওয়ার নিদর্শন রয়েছে । ইউটিউবে সার্চ  করলেই অনেক তথ্য পাওয়া যাবে ।

 

 

 

আমাদের কুরবানীর উৎস

কুরবানীর ইতিহাস ও শিক্ষা
কুরবানীর ইতিহাস ও শিক্ষা

প্রিয় পাঠক বন্ধুরা । আপনারা এতোক্ষণ কোরবানীর আলোচনা জানছিলেন । কোরবানির শুরু ও সূচনা আদম আলাই সাল্লাম এর পুত্রদয় হাবিল কাবিল থেকে হয়েছিল । কিন্তু আমাদের কুরবানীর সম্পর্ক হযরত ইব্রাহিম আলাইহি সালামের পুত্র কোরবানির অনুস্মরণীয় ঘটনার সাথে জড়িত । আর সে ঘটনার স্মারক হিসেবেই উম্মতে মুহাম্মদের উপর কোরবানি ওয়াজিব করা হয়েছে । হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের সেই ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজীর বিহীন অবিস্বরণীয় ও শিক্ষনীয় ঘটনা ।

 

 

কোরবানির তাৎপর্য উদ্দেশ্য বুঝাবার জন্য এ ঘটনা হলো একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু ।

 

হযরত ইব্রাহিম আঃ এর পুত্র লাভ

 

শামদেশে (সিরিয়া) হিজরতের সময় ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের বয়স অধিকাংশ তাফসীরকারকের মতে ৭৫ বছর ছিল এবং তার স্ত্রী সারা ও হাজেরা বয়স্কা ছিলেন। হিজরত করে শামে পৌঁছে তারা সেখানে বসবাস করতে থাকেন এবং দীনের দাওয়াত দিতে থাকেন।

 

 

অতঃপর ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের বিবিগণ বার্ধক্যে পৌঁছলেও এ পর্যন্ত কোন সন্তান না হওয়ায় তিনি স্বীয় ওয়ারিস কামনা করে আল্লাহ তাআলার দরবারে দু‘আ করলেন- رب هب لي من الصالحين 

অর্থাৎ হে পরওয়ারদেগার ! আমাকে সৎপুত্র সন্তান দান করো । (সুরা সাফফাত: ১০০ )

তার এ দোয়া কবুল করা হয় এবং আল্লাহ তাআলা তাকে এক পুত্রের সুসংবাদ শুনিয়ে দেন-فبشرناه بغلام حليم .

অর্থ: অতঃপর আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম । ( সূরা সাফফাত: ১০১ )

 

 

সহনশীল বলে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে এ নবজাতক তার জীবনে সবর ধৈর্য ও সহনশীলতার এমন পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করবে , যার দৃষ্টান্ত দুনিয়ার কেউ কোনদিন পেশ করতে পারবে না । বাস্তবেও ঠিক তাই হয়েছিল ।

 

তখন ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম বললেন, আয় আল্লাহ, আপনি আমাকে কীভাবে সন্তান দান করবেন? আমার তো সন্তান হয় না এবং আমার স্ত্রী তো বৃদ্ধ। আল্লাহ তা‘আলা ওহী পাঠালেন, আপনার এই স্ত্রীর মাধ্যমেই সন্তান হবে। তখন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ছোট বিবি হাজেরা আলাইহিস সালাম গর্ভবতী হলেন।

 

 

যখন হযরত সারা আলাইহিস সালাম হযরত হাজেরার গর্ভবতী হওয়ার সংবাদ শুনলেন, তখন তিনি নিজের সন্তান না হওয়ার কারণে মনে ব্যথা পেলেন এবং হাজেরাকে উপেক্ষা করতে লাগলেন। তাই একপর্যায়ে হাজেরা সারার কাছ থেকে দূরে স্থানীয় একটি ঝর্নার কাছে চলে গেলেন। সেখানে একজন ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে সারার খাদেমা, আপনি কোথা থেকে এলেন এবং কোথায় যাচ্ছেন?

 

হযরত হাজেরা বললেন, সারার কাছ থেকে এসেছি। ফেরেশতা বললেন, আপনি তাঁর নিকট ফিরে যান এবং তাঁর অধীনেই থাকুন। আর সুসংবাদ গ্রহণ করুন নেক সন্তানের। অতঃপর ফেরেশতা তাকে বললেন, হে হাজেরা, আপনি গর্ভবতী হয়েছেন এবং আপনি এমন এক ছেলে জন্ম দিবেন, যার নাম হবে ইসমাঈল। 

 

 

 

সেখান থেকে ফিরে হযরত হাজেরা আলাইহিস সালাম ফেরেশতাদের সুসংবাদ অনুযায়ী একটি পুত্রসন্তান জন্ম দিলেন। তার নাম ইসমাঈল রাখা হলো। যখন হযরত হাজেরার গর্ভে পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হলো, তখন ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বয়স ৮৬ বছর ছিল। (কাসাসূল আম্বিয়া, ১১৯ পৃষ্ঠা)

 

 

 

অবশ্য হযরত সারার গর্ভে পরবর্তীতে হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের দ্বিতীয় পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেন । যার নাম রাখেন তিনি ইসহাক । এ সময় হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের বয়স হয়েছিল ১২০ বছর ও সারা আলাইহিস সালামের বয়স হয়েছিল ৯৯ বছর।

 

একটু আগে উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহ তাআলার নিকট পুত্রসন্তান লাভের জন্য দু‘আ করলেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে হযরত হাজেরা ‘আলাইহিস সালামের গর্ভে পুত্রসন্তান দান করলেন তার নাম রাখা হয় ইসমাঈল। এরপর আল্লাহ তাআলার নির্দেশে হযরত ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম স্ত্রী হাজেরা ও প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাঈলকে মক্কার জনমানবহীন মরু প্রান্তরে রেখে আসেন। অতঃপর মাঝে মধ্যে তিনি শাম থেকে মক্কায় এসে স্ত্রী-পুত্রের খোঁজখবর নিতেন।

 

 

এভাবেই বয়ে চলছিল সময়।

এক সময় শিশু ইসমাঈল আলাইহিস সালাম কৈশোরে পা রাখলেন।

নির্বাসিত এলাকা পবিত্র মক্কা নগরীতে লালন পালনের দীর্ঘ কষ্ট সহ্য করার পর সন্তান যখন বিপদে আপদে, কাজে-কর্মে পিতার পাশে দাঁড়াবার বয়সে পৌঁছল তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ হলো প্রিয় বস্তুকে কুরবানি করার । কুরবানির এ আদেশটি ছিল স্বপ্নের মাধ্যমে । নবীদের স্বপ্ন হয় ওহী । তাই নবীগণ যা স্বপ্ন দেখেন তাতে কোন সন্দেহ থাকে না । নবীদের স্বপ্ন হলো দলীল । তাই স্বপ্ন অনুযায়ী তিনি পুত্রকে কোরবানি করার জন্য প্রস্তুতি নিলেন ।

 

 

প্রিয় পাঠক বন্ধুরা । মনে রাখবেন আমাদের স্বপ্ন যদি শরীয়ত বিরোধী হয় তাহলে সেটা করা যাবে না । যেমন কেউ যদি স্বপ্ন দেখে অমুক মাজারে শিন্নি-পায়েস দাও । গরু-ছাগল দাও অথবা অমুক পূজা মন্ডপে সাপকে দুধ কলা দাও। রাস্তার মোড়ে ভোগ দাও তাহলে এসব স্বপ্ন অনুযায়ী আমল করা যাবে না । এগুলো শয়তানের পক্ষ থেকে স্বপ্ন । আর যদি শরীয়ত মোতাবেক কোন স্বপ্ন হয় তাহলে সেটা ভালো । তার আলাদা মূল্য ও ব্যাখ্যা আছে ‌।

 

হযরত ইসমাইলের বয়স যখন ১৩ বছর মতান্তরে সাবালক তখন মূলত এ কুরবানির আদেশটি করা হয়েছিল । যার বর্ণনা পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এভাবে দিয়েছেন-

فَلَمَّا بَلَغَ مَعَہُ السَّعۡیَ قَالَ یٰبُنَیَّ اِنِّیۡۤ اَرٰی فِی الۡمَنَامِ اَنِّیۡۤ اَذۡبَحُکَ فَانۡظُرۡ مَاذَا تَرٰی ؕ قَالَ یٰۤاَبَتِ افۡعَلۡ مَا تُؤۡمَرُ ۫ سَتَجِدُنِیۡۤ اِنۡ شَآءَ اللّٰہُ مِنَ الصّٰبِرِیۡنَ

 

অনুবাদ: অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখিযে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ। সে বললঃ পিতাঃ! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন। (আস ছাফ্‌ফাত – ১০২)

 

 

হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম স্বপ্নের আদেশ অনুযায়ী পুত্রকে কোরবানি করার জন্য মিনার ময়দানে নিয়ে গেলেন। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে কোরবানির আদেশ দেওয়া হয়েছে তা তিনি অবশ্যই করবেন তারপরও তিনি পুত্রের কাছে জানতে চাইলেন পুত্রকে পরীক্ষা করার জন্য । নবীর পুত্র পরীক্ষায় ফেল করার তো নয় । পুত্র জবাব দিলেন-

ؕ قَالَ یٰۤاَبَتِ افۡعَلۡ مَا تُؤۡمَرُ ۫ سَتَجِدُنِیۡۤ اِنۡ شَآءَ اللّٰہُ مِنَ الصّٰبِرِیۡنَ .

অনুবাদ: হে পিতা ! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন। (আস ছাফ্‌ফাত – ১০২)

এই উত্তরে হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর বিনয় ও আত্ম নিবেদনের পরিচয় তো পাওয়া যায়, তদুপরি প্রতীয়মান হয় যে এমন কচি বয়সে আল্লাহ তাআলা তাকে কী পরিমাণ মেধা ও জ্ঞান দান করেছিলেন যে তিনি হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের স্বপ্নের কথায় বুঝে ফেলেছিলেন আল্লাহর হুকুমের কথা ‌।

 

 

তারা পিতা পুত্র উভয়েই আল্লাহর সামনে নিজেদেরকে আত্মসমর্পণকারী হিসাবে প্রমাণিত করলেন। যা হোক হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম পুত্র জবাই করার উদ্যোগ নিলেন। কুরআনুল কারীমের এসেছে-

فَلَمَّاۤ اَسۡلَمَا وَتَلَّہٗ لِلۡجَبِیۡنِ ۚ .وَنَادَیۡنٰہُ اَنۡ یّٰۤاِبۡرٰہِیۡمُ .

قَدۡ صَدَّقۡتَ الرُّءۡیَا ۚ اِنَّا کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡمُحۡسِنِیۡنَ.

اِنَّ ہٰذَا لَہُوَ الۡبَلٰٓـؤُا الۡمُبِیۡنُ .وَفَدَیۡنٰہُ بِذِبۡحٍ عَظِیۡمٍ .

 

অনুবাদ:যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহীম তাকে যবেহ করার জন্যে শায়িত করল।

তখন আমি তাকে ডেকে বললামঃ হে ইব্রাহীম,

তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে! আমি এভাবেই সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।

আমি তার পরিবর্তে দিলাম যবেহ করার জন্যে এক মহান জন্তু।(আস ছাফ্‌ফাত – ১০৩-১০৭)

তাফসীরের কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে অবশেষে তারা  উভয়ে যখন কোরবানগাহে পৌঁছলেন । তাদের উভয়ের হৃদয়ে অনুভূতিগুলো তখন কেমন আলোড়ন তুলেছিল তা ভাষায় ব্যক্ত করা মানুষের সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের বর্ণনায় সামান্য উল্লেখ করে এই ব্যাপারটি মানুষের উপলব্ধির উপর ছেড়ে দিয়েছেন।

 

 

তখন মানুষের চরম শত্রু ইবলীস তখন হযরত ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামকে প্রতারিত করার জন্য তিন তিনবার ফন্দি আঁটল। কিন্তু আল্লাহর খলীল সাত সাতটি করে কংকর নিক্ষেপ করে শয়তানের সব চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিলেন।
নোট:  বর্তমানে হাজী সাহেবগণ মিনায় তিন জামরায় কংকর নিক্ষেপ করে সেই স্মৃতিকে ধারণ করে রেখেছেন।

আর তখন হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম পিতাকে বললেন, হে আমার পিতা ! আমাকে খুব শক্ত করে বেধে নিন । যাতে আমি ছটফট করতে না পারি । আপনার পরিধেয় বস্ত্র সামলে নিন । যাতে আমার রক্তের ছিটা তাতে না লাগে । এতে সওয়াব হ্রাস পেতে পারে । এছাড়া রক্ত দেখলে আমার মা ব্যাকুল হবেন । আর আপনার ছুরিটা একটু ধার দিয়ে নিন এবং তা আমার গলা দ্রুত চালান । যাতে আমার প্রাণ সহজে বের হয়ে যায় । কারণ মৃত্যু বড় কঠিন ব্যাপার । আপনি আমার মায়ের কাছে পৌঁছে আমার সালাম বলবেন । যদি আমার জামা তার কাছে নিয়ে যেতে চান তবে নিয়ে যাবেন । এতে হয়তো তিনি সান্তনা খুঁজে পাবেন ।

 

 

 

একমাত্র পুত্রের মুখে এসব কথা শুনে পিতার কী অবস্থা হতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দৃঢ়তার সাথে অটল পাহাড় হয়ে বললেন, “বেটা, আল্লাহ তা‘আলার হুকুম পালনে তুমি কতইনা উত্তম সহযোগী!” তারপর তিনি পুত্রকে চুমু খেলেন এবং ভালো করে বেঁধে মাটিতে শুইয়ে দিলেন। 

হযরত ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম পুত্র ইসমাঈলকে কাত করে এমনভাবে শোয়ালেন যে, কপালের একদিক মাটি স্পর্শ করেছিল।

অপর বর্ণনায় আছে, প্রথমে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম পুত্রকে চিৎ করে শুইয়ে দিলেন। তারপর আল্লাহর নাম নিয়ে বারবার ছুরি চালানো সত্ত্বেও যখন ইসমাঈল আলাইহিস সালামের গলা কাটছিল না এবং জবাইয়ের কাজ সম্পন্ন হচ্ছিল না, তখন পুত্র নিজেই আবদার করে বললেন, আব্বাজান আমাকে উপুড় করে শুইয়ে দিন। কারণ আমার মুখমণ্ডল দেখে আপনার মধ্যে পিতৃস্নেহ উথলে ওঠে। ফলে পূর্ণশক্তি দিয়ে গলা কাটা হয় না। তাছাড়া ছুরি দেখে আমিও ঘাবড়ে যাই ।

একথা শুনে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম পুত্রের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে উপুড় করে শোয়ালেন এবং তার গলায় সজোরে ছুরি চালালেন।

কিন্তু তখনও গলা কাটা গেল না। কেননা, মূলত আল্লাহ তাআলা তখন ছুরি ও গলার মাঝখানে একটি পিতলের টুকরোর প্রতিবন্ধক রেখে দিয়েছিলেন। ফলে শত চেষ্টার পরও হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের গলা কাটলো না। তখন হঠাৎ আল্লাহর ঘোষণা-

قَدۡ صَدَّقۡتَ الرُّءۡیَ

অর্থঃ হে ইবরাহীম, নিশ্চয় আপনি স্বপ্নের নির্দেশ পালন করেছেন- শুনে উপরের দিকে তাকিয়ে হযরত জিবরাইল ‘আলাইহিস সালামকে একটি ভেড়া নিয়ে উপস্থিত দেখতে পান। এই জান্নাতী ভেড়া হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে দেওয়া হলে তিনি আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে পুত্রের পরিবর্তে সেটি কুরবানী করেন।

নোট:

হযরত ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম কর্তৃক ইসমাঈল ‘আলাইহিস সালামের কুরবানীর ঘটনা মিনায় সংঘটিত হয়েছিল। তাই এ স্থানেই হজ্জের সময় কুরবানী আদায় করা হয়। এভাবে আজ পর্যন্ত হজ্জ আদায়কারীগণ এই স্থানে কুরবানী আদায় করে সেই পবিত্র স্মৃতি ধারণ করে আছেন।

 

কোন কোন বর্ণনায় আছে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন তার পুত্র নবী হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে কুরবানী করার জন্য মাটিতে শুইয়ে তার গলায় ছুরি চালাচ্ছিলেন ঠিক এমনই মুহূর্তে আল্লাহ তাআলা ফেরেস্তা হযরত জিবরাঈল আলাইহি সালামকে নির্দেশ দিলেন একটি জান্নাতি দুম্বা নিয়ে দ্রুত হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের কাছে পৌঁছার জন্য । তখন হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম খুব দ্রুত আসছিলেন । কিন্তু দূর থেকে দেখতে পেলেন হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম তার পুত্রের গলায় ছুরি চালাচ্ছিলেন। তখন হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম অসংখ্য করেন যে তিনি প্রচার পূর্বেই বুঝি ইসমাইল আলাইহিস সালাম কুরবানী হয়ে যাবেন । তাই তিনি উচ্চস্বরে বলে উঠলেন-

الله اكبر الله اكبر

হযরত জিবরাঈল আলাইহি সালামের তাকরীর পাঠ শুনে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বলে উঠলেনঃ

لا اله الا الله  والله اكبر

হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর তাকবীর শুনে এবং দুম্বা জবাই হতে দেখে

হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম বলে উঠলেন-

و الله اكبر ولله الحمد

আর এভাবে তিনজনের জিকিরের একত্র রুপ হলো তাকবীরে তাশরীক ।

 

তাকবীরে তাশরীক

الله اكبر الله اكبر لا اله الا الله والله اكبر الله اكبر ولله الحمد.

তাকবীরে তাশরীকের বাংলা উচ্চারণ:

আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার,লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ও আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ও লিল্লাহিল হামদ ।

 

তাকবীরে তাশরীকের অর্থ:

আল্লাহ সবচেয়ে বড় আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই । আর আল্লাহ সবচেয়ে বড় আল্লাহ সবচেয়ে বড়, সকল প্রশংসা শুধু তারই ।

এই বাক্য গুলো আল্লাহ তাআলার কাছে এত পছন্দনীয় হয়েছে যে তিনি এটি পাঠ করা উম্মতে মুহাম্মদের উপর ওয়াজিব করে দিয়েছেন ।

তাকবীরে তাশরীকের বিধান

 

জিলহজ্ব মাসের ১০–১২ তারিখ থেকে কুরবানীর আমল যেমন ওয়াজিব তেমনি তাকবীরে তাশরীক অর্থাৎ জিলহজ মাসের ৯ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের সালাম ফিরানোর পর পুরুষদের জন্য উচ্চস্বরে এবং মহিলাদের জন্য নিম্নস্বরে একবার তাকবীরে তাশরিক পড়া ওয়াজিব । কোথাও কোথাও তিনবার পড়ার প্রচলনও আছে।

 

কুরবানীর শিক্ষা

ইসলামে কয়েক ধরণের কুরবানী আছে।

তার ভেতরে প্রধান তিনটি।

১. প্রাণের কুরবানী ২. মালের কুরবানী ৩. মনের কুরবানী।

এই প্রকার কুরবানীর মধ্যে মনের কুরবানী হচ্ছে আসল ।‌‌ আর মনের কুরবানীতে ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম পরিপূর্ণ সফল ।

কুরবানী থেকে আমাদের অনেক শিক্ষা রয়েছে ।‌‌যেমন:

১. ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম স্বপ্ন দেখার পরেও কোরবানি করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন । মনের কোরবানি করতে পেরেছিলেন । এরকম মনের কোরবানি করতে পারা একটি বড় শিক্ষা ।

২. কোরবানি আমাদের ত্যাগ ও উৎসর্গ শিক্ষা দেয় । আমাদের ওপর ইসলামের যে বিধান আবশ্যক তা পালন করতে হবে । আল্লাহর রাজি খুশির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালাতে হবে ।

৩. কোরবানি আমাদেরকে ইখলাসে নিয়ত ও তাকওয়া শিক্ষা দেয় । আসলে নিয়ত ছাড়া কোন কাজেরই সওয়াব বা মূল্য থাকে না এটার তালিম দেয় ।

 

ইব্রাহিম আঃ এর জীবন থেকে শিক্ষা

 

হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের গোটা জীবন উম্মতের জন্য শিক্ষা। তার সম্পর্কে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَمَنْ اَحْسَنُ دِیْنًا مِّمَّنْ اَسْلَمَ وَجْهَهٗ لِلّٰهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ وَّ اتَّبَعَ مِلَّۃَ اِبْرٰهِیْمَ حَنِیْفًا ؕ وَاتَّخَذَ اللهُ اِبْرٰهِیْمَ خَلِیْلًا ○

 

অনুবাদ: উত্তম দীন তার চেয়ে আর কার হতে পারে, যে তার মস্তক আল্লাহর জন্য অবনত করেছে আর সে উত্তম আমলকারী এবং সে একনিষ্ঠ ইবরাহীমের মিল্লাতের অনুসরণ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীমকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানিয়েছেন। (সূরা নিসা, আয়াত: ১২৫)

হযরত ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের জীবনের বিশেষ বিশেষ শিক্ষণীয় দিক উল্লেখ করে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, হযরত ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম ঐ ব্যক্তি, যিনি সর্বপ্রথম সালোয়ার পরিধান করেন, দীনের খাতিরে পিতা থেকে পৃথক হন, আল্লাহর হুকুম পালনে খাৎনা করেন (তখন তার বয়স ছিল ১২০ বছর), অপূর্ব মেহমানদারি করেন, আল্লাহর নির্দেশে হজ্জের ঘোষণা করেন এবং তিনি আল্লাহ তা‘আলার সকল পরীক্ষায় তথা জন্মভূমি ত্যাগ, পুত্র কুরবানী করা, ঈমানের জন্য আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া ইত্যাদি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। যার ফলে তিনি খলীল উপাধিতে ভূষিত হন।

হযরত ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম যেভাবে নিজেকে আল্লাহর জন্য নিবেদিত করে সকলকিছু আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্যই করেছেন এবং আল্লাহর দীন পরিপূর্ণভাবে প্রতিপালন করেছেন আর দাওয়াতের ক্ষেত্রে যে নিয়ম-নীতি অবলম্বন করেছেন, তার সেই শিক্ষা আমাদের গ্রহণ করা উচিত। এ মর্মে তার জীবন থেকে আমাদের জন্য বিশেষ শিক্ষণীয় বিষয় হলো,

 

১. কঠিন বিপদের সময় আল্লাহ তা‘আলার কথা স্মরণ রাখা।

২. ঈমান রক্ষার জন্য প্রয়োজনে পিতা-মাতাসহ আত্মীয়স্বজন থেকেও বিচ্ছিন্ন হওয়া।

৩. পরিপূর্ণ দীন মানার জন্য প্রয়োজনে জন্মভূমি ত্যাগ করা।

৪. সর্বাবস্থায় আল্লাহর হুকুম মাথা পেতে মেনে নেওয়া।

৫. দীনের প্রচারকার্যে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা প্রয়োগ করা।

৬. প্রচার ও সংশোধন কাজে সর্বক্ষেত্রে কঠোরতা না করা, বরং অবস্থাভেদে নম্রতার স্থলে নম্রতা ও কঠোরতার স্থলে কঠোরতা অবলম্বন করা।

৭. কাফের-মুশরিকদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না রাখা।

৮. আল্লাহ তা‘আলার হুকুমের সামনে যুক্তি পেশ না করা।

৯. নিজের সর্বাধিক প্রিয় বস্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত করা।

১০. স্ত্রী-সন্তানের উপরে আল্লাহর হুকুম প্রাধান্য দেওয়া।

১১. বিভিন্ন কাজে পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু‘আ করা।

এভাবে মানবজাতির জন্য জীবনে অসংখ্য শিক্ষা রেখে গেছেন। আল্লাহ তাআলা সবাইকে তার আদর্শ মেনে চলার তাওফীক দান করুন। আমীন।

 

লিখেছেন: মাওলানা শরিফ আহমাদ

ঢাকা, বাংলাদেশ ।

 

 

 

 

 

Related Articles