ইসলাম

এতেকাফ করার নিয়ম এতেকাফের ফজিলত মাওলানা শরিফ আহমাদ

এতেকাফ করার নিয়ম এতেকাফের ফজিলত

 

 

চলছে মাহে রমজান । অসংখ্য ইবাদতের মধ্যে এতেকাফ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত । এই ইবাদতের গুরুত্ব -ফজিলত, প্রকারভেদ, শর্ত ও নিয়মাবলী অনেকের অজানা। তাই এতেকাফ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রয়োজনীয় তথ্য ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে ।

পড়ুন – শবে কদরের নামাজের নিয়ম ও নিয়ত 

এতেকাফ অর্থ কি

 

এতেকাফ একটি আরবী শব্দ । শব্দটির অর্থ হলো নিঃসঙ্গতা ,বিচ্ছিন্নতা ,অবস্থান করা ইত্যাদি ।

 

এতেকাফ কাকে বলে ?

 

শরীয়তের পরিভাষায় এতেকাফ বলা হয়- ছেলে মেয়ে, আত্মীয় স্বজন ,ব্যবসা-বাণিজ্যসহ দুনিয়ার সকল প্রকার কার্যকলাপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের লক্ষ্যে মসজিদ বা ঘরে নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করাকে ।

 

 

এতেকাফ কয় প্রকার ?

 

এতেকাফ ৩ প্রকার । ১. ওয়াজিব ২. সুন্নাত ৩. মুস্তাহাব

 

ওয়াজিব এতেকাফ:

 

এটা হচ্ছে মান্নতের এতেকাফ । কেউ মান্নত করল আমার উমুক কাজ সমাধান হয়ে গেলে ৫ দিন দশ দিন এতেকাফ করব । তখন উক্ত উদ্দেশ্য সিদ্ধি হয়ে গেলে তাকে নির্দিষ্ট দিনগুলোর এতেকাফ অবশ্যই করতে হবে । কেননা তখন তা তার উপর ওয়াজিব হয়ে যায় । মান্নতের ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত অর্থাৎ রোজা না রেখে ওয়াজিব এতেকাফ করা যায় না ।

 

সুন্নাতে মুআক্কাদা কিফায়া:

 

রমজানের শেষ দশ দিন অর্থাৎ ২১ রমজানের সূর্য ডোবার আগ মুহূর্ত থেকে শাওয়াল মাসের চাঁদ ওঠার পর্যন্ত মসজিদে এতেকাফ করা সুন্নতে মুআক্কাদা কিফায়া বলে ।‌ মহল্লাবাসীর পক্ষে কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি এতেকাফ করলে সকলের পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে । অন্যথায় গ্রামবাসী সকলেই সুন্নতে মুআক্কাদা পরিত্যাগকারী হিসেবে গোনাহগার হবে ।

 

মুস্তাহাব বা নফল এতেকাফ:

 

মুস্তাহাব বা নফল ই’তিকাফের জন্য কোন দিন বা সময় এর পরিমাপ নেই এবং রোজা রাখাও শর্ত নয় । অল্প স্বল্প সময়ের জন্য তা হতে পারে । এজন্য যে কোন সময় মসজিদে প্রবেশের সময় যদি এতেকাফের নিয়ত করা হয় তাহলে মসজিদে অবস্থানকালীন নামাজ, জিকির- আযকার, কুরআন তেলাওয়াত যা করা হোক তার সওয়াব তো পাওয়া যাবেই সাথে সাথে আলাদা এতেকাফের সওয়াব পাওয়া যাবে ।

 

 

কুরআনের আলোকে এতেকাফ

 

এতেকাফ শরীয়ত সম্মত গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল । এ ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ তাআলার নির্দেশ সম্বলিত ঘোষণা –

وَاِذۡ جَعَلۡنَا الۡبَیۡتَ مَثَابَۃً لِّلنَّاسِ وَاَمۡنًا ؕ وَاتَّخِذُوۡا مِنۡ مَّقَامِ اِبۡرٰہٖمَ مُصَلًّی ؕ وَعَہِدۡنَاۤ اِلٰۤی اِبۡرٰہٖمَ وَاِسۡمٰعِیۡلَ اَنۡ طَہِّرَا بَیۡتِیَ لِلطَّآئِفِیۡنَ وَالۡعٰکِفِیۡنَ وَالرُّکَّعِ السُّجُوۡدِ

কুরআনের আলোকে এতেকাফ

অনুবাদ: যখন আমি কাবা গৃহকে মানুষের জন্যে সম্মিলন স্থল ও শান্তির আলয় করলাম, আর তোমরা ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাযের জায়গা বানাও এবং আমি ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফকারী, অবস্থানকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ। (আল বাকারা – ১২৫)

 

ۚ وَلَا تُبَاشِرُوۡہُنَّ وَاَنۡتُمۡ عٰکِفُوۡنَ ۙ فِی الۡمَسٰجِدِ ؕ تِلۡکَ حُدُوۡدُ اللّٰہِ فَلَا تَقۡرَبُوۡہَا ؕ کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰہُ اٰیٰتِہٖ لِلنَّاسِ لَعَلَّہُمۡ یَتَّقُوۡنَ

 

অনুবাদ: আর যতক্ষণ তোমরা এতেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিশো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমানা। অতএব, এর কাছেও যেও না। এমনিভাবে বর্ণনা করেন আল্লাহ নিজের আয়াত সমূহ মানুষের জন্য, যাতে তারা বাঁচতে পারে। (আল বাকারা – ১৮৭)

 

 

এতেকাফ সম্পর্কিত হাদীস

 

১. নং হাদীস:

عن ابي هريره رضي الله عنه قال: كان النبي صلى الله عليه وسلم يعتكف في كل رمضان عشرة ايام، فلما كان العام الذي قبض فيه اعتكف عشرين يوما .

 

অনুবাদ:হযরত আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রমজানের ১০ দিন এতেকাফ করতেন । তবে যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন সে বছর ২০ দিন এতেকাফ করেছিলেন ।

( সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০৪৪)

 

২ নং হাদীস

 

عن عائشه رضي الله عنها قالت: كان رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا دخل العشر احيا الليل وايقظ اهله وجد وشد المئذر.

অনুবাদ: হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহা থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন রমজানের শেষ দশক আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারারাত জেগে থাকতেন ও নিজ পরিবারের লোকদের ঘুম থেকে জাগাতেন এবং তিনি নিজেও ইবাদাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন ।

( সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৮৪৪)

 

৩ নং হাদীস

 

عن عائشه رضي الله عنها قالت قال النبي صلى الله عليه وسلم يعتكف في العش الاواخر من رمضان فكنت اضرب له خباءا فيصلي الصبح ثم يدخله.

 

অনুবাদ: হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহা থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করতেন । আর আমি তার জন্য তাঁবু বানিয়ে দিতাম । তিনি ফজরের নামাজ আদায় করে তাতে প্রবেশ করতেন ‌। ( বুখারী ও মুসলিম)

 

৪ নং হাদীস

 

عن عائشه رضي الله تعالى عنها قالت وان كان رسول الله صلى الله عليه وسلم ليدخل على راسه وهو في المسجد فارجله وكان لا يدخل البيت الا لجاحة اذا كان معتكفا .

 

অনুবাদ: হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে (এতেকাফে) থাকা অবস্থায় আমার দিকে তার মাথা ঝুঁকিয়ে দিতেন এবং আমি আঁচড়িয়ে দিতাম আর তিনি ইতিকাফে থাকা অবস্থায় প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া গৃহে প্রবেশ করতেন না ।

( সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০২)

 

 

এতেকাফের গুরুত্ব ও ফজিলত

 

এতেকাফ আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের সহজ একটি মাধ্যম । আল্লাহর সঙ্গে সুনিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার সহজ একটি উপায় । কারন মানুষ যখন সংসার জগতের কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে আল্লাহর ঘরে ইবাদত-বন্দেগির জন্য আত্মনিয়োগ করবে তখন আল্লাহ তাআলা কি তার থেকে বিমুখ থাকতে পারেন ? কখনোই না । বরং তিনি ঘোষণা দিয়েছেন বান্দা আমার প্রতি এক হাত অগ্রসর হলে আমি তার দিকে দুই হাত অগ্রসর হয়ে যাই । আমার দিকে বান্দা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলে আমি তার দিকে দৌড়ে যাই । অতএব বোঝা গেল এতেকাফ আল্লাহপাকের সান্নিধ্য অর্জনের সহজ একটি কার্যকরী ফর্মুলা । এতেকাফের ফজিলত সংক্রান্ত তিনটি হাদীস ।

 

পড়ুন – রোজার মাসআলা মাসায়েল 

 

১ নং হাদীস

 

হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত । কেউ যখন আল্লাহর ঘর মসজিদে অবস্থান নেয় তখন আল্লাহ তাআলা এতো বেশি আনন্দিত হন যেমন বিদেশ বিভুঁই থেকে কেউ বাড়িতে এলে আপনজনরা আনন্দিত হয়ে থাকে । (তারগিব-তারহিব, ৩২২)।

 

২ নং হাদীস

 

যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এক দিন এতেকাফ করবে আল্লাহ তাআলা তাঁর এবং জাহান্নামের মাঝে ৩ খন্ড দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন অর্থাৎ আসমান ও জমিনের দূরত্ব থেকে অধিক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। (শুয়াবুল ঈমান,হাদীস নং ৩৯৬৫)

 

৩ নং হাদীস

 

হযরত আলী বিন হুসাইন রাদিআল্লাহু আনহু নিজ পিতা থেকে বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে ব্যক্তি রমজানের দশদিন ইতেকাফ করে তা দুই হজ্জ ও দুই ওমরার সমান ‌। (সুনানে বায়হাকি)।

 

 

রমজানের এতেকাফ

 

রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদা কেফায়া অর্থাৎ বড় গ্রাম বা শহরের প্রত্যেকটা মহল্লায় এবং ছোট গ্রামের পূর্ণ বসতিতে কেউ কেউ এতেকাফ করলে সকলের দায়িত্ব মুক্ত হয়ে যাবে । আর কেউ না করলে সকলে সুন্নাত তরকের জন্য দায়ী হবে ।

 

এতেকাফের নিয়ম কানুন

এতেকাফ কতদিন ?

 

রমজানের ২০ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত এতেকাফের সময় । মোট ১০ দিন ।

 

 

এতেকাফের শর্ত কয়টি ?

 

এতেকাফের জন্য তিনটি শর্ত । যথা:

১. এমন মসজিদে এতেকাফ করতে হবে যেখানে নামাজের জামাত হয় । জুমার জামাত হোক বা না হোক । এই শর্ত পুরুষদের এতেকাফের ক্ষেত্রে । মহিলাগণ ঘরে নির্দিষ্ট স্থানে এতেকাফ করবে ।

 

২. এতেকাফের নিয়ত করতে হবে ।

৩. হায়েজ-নেফাছ শুরু হলে এতেকাফ ছেড়ে দিবে ।

 

 

এতেকাফ ভঙ্গের কারণ

 

১. স্ত্রী সহবাস করলে এতেকাফ ফাসেদ হয়ে যায় । তাই বীর্যপাত হোক বা না হোক । ইচ্ছাকৃত হোক বা ভুলে হোক । সহবাসের আনুষঙ্গিক কাজ যেমন চুম্বন আলিঙ্গন ইত্যাদি কারণে বীর্যপাত হলে এতেকাফ ফাসেদ হয়ে যায় । চুম্বন ইত্যাদির কারণে বীর্যপাত না হলে এতেকাফ বাতিল হয় না । তবে এতেকাফের অবস্থায় তা করা হারাম ।

২. এতেকাফের স্থান থেকে শরীয়ত সম্মত প্রয়োজন বা স্বাভাবিক প্রয়োজন ছাড়া বের হলে এতেকাফ ফাসেদ হয়ে যায় । শরিয়াত সম্মত প্রয়োজন হলে মসজিদের বাইরে যাওয়া যায় । যেমন সে মসজিদে জুমার জামাত না হলে জুমার নামাজের জন্য অন্য জামে মসজিদে যাওয়া । ফরজ বা সুন্নাত গোসলের জন্য বের হওয়া ইত্যাদি । আর স্বাভাবিক প্রয়োজনে বের হওয়া যায় । যেমন পেশাব পায়খানার জন্য বের হওয়া , খাদ্যদ্রব্য এনে দেওয়ার লোক না থাকলে তা আনার জন্য বের হওয়া , মসজিদের ভেতর অজুর পানির ব্যবস্থা না থাকলে এবং পানি দেওয়ার কেউ না থাকলে অজুর পানির জন্য বাইরে যাওয়া।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: উল্লিখিত দুটি কারণে এতেকাফ নষ্ট হয়ে যায় এবং কাজা করতে হয় ।

 

 

এতেকাফ কাজা করার নিয়ম

 

এতেকাফ কাজা করার সময় দিনের সাথে রাতকেও শামিল করতে হবে । যেমন কেউ সূর্যাস্তের সময় এতেকাফ শুরু করলে পরের দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করতে হবে ।‌‌ (ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী, খণ্ড নং ১ পৃষ্ঠা নং ২১৪)

 

পড়ুন – কোরআন খতম করার সঠিক নিয়ম 

এতেকাফের মাসআলা

 

* যে কাজের জন্য বাইরে যাওয়া হবে সে কাজ সমাপ্ত করার পর দ্রুত ফিরে আসবে । বিনা প্রয়োজনে কারো সঙ্গে কথা বলবে না ।

* গোসল ফরজ হওয়া ছাড়াও শরীর ঠান্ডা করার নিয়তে বা শরীর পরিষ্কার করার নিয়তে সাধারণত যে গোসল করা হয় শুধু এরুপ গোসলের উদ্দেশ্য মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না । তবে কাউকে বলে যদি পথের মধ্যে পানির ব্যবস্থাবস্থা করে রাখে বা পুকুর থাকে আর পেশাব পায়খানা থেকে ফেরার পথে অতিরিক্ত সময় না লাগিয়ে জলদি ওই পানি গায়ে মাথায় ঢেলে দিয়ে গোসল শেষে চলে আসে তাহলে এতেকাফের ক্ষতি হবে না।

* কোন শরীয়াত সম্মত প্রয়োজনে বা স্বাভাবিক প্রয়োজনে বের হলে এত্যবসরে কোনো রোগী দেখলে বা জানাজায় শরিক হলে তাতে কোন দোষ নেই ‌।

* পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এতেকাফে বসা বসানো উভয়টা নাজায়েজ ও গোনাহের কাজ ।

* এতেকাফের মানত করলে এতেকাফ ওয়াজিব হয়ে যায় । তবে কোন শর্তের ভিত্তিতে মানত করলে যেমন আমার উমুক কাজ হয়ে গেলে এতেকাফ করব ইত্যাদি । শর্ত পূরণ হওয়ার পূর্বে ওয়াজিব হয় না ।

* ওয়াজিব এতেকাফের জন্য রোজার শর্ত । যখনই এতেকাফ করবে রোজা রাখতে হবে ‌।

* ওয়াজিব এতেকাফ কমপক্ষে এক দিন হতে হবে । বেশি দিনের নিয়ত করলে তাই করতে হবে ।

* যদি শুধু একদিনের এতেকাফের মানত করে তাহলে তার সঙ্গে রাত শামিল হবে না । তবে যদি রাত দিন উভয়ের নিয়ত করে বা একত্রে কয়েক দিনের মানত করে তাহলে রাত শামিল হবে । দিন বাদে শুধু রাতে এতেকাফের মানত হয় না ।

* সুন্নাত এতেকাফ ( রমজানের শেষ দশক) ও ওয়াজিব এতেকাফ ব্যতীত অন্যান্য যেকোনো সময়ের এতেকাফের জন্য কোন পরিমাণ সময় নির্ধারিত নেই । সামান্য সময়ের জন্য তা হতে পারে ।

* যেসব জিনিস দ্বারা এতেকাফ ফাসেদ হয়ে যায় এবং কাজা করতে হয় সেসব দ্বারা মুস্তাহাব এতেকাফও নষ্ট হয়ে যাবে । তবে মুস্তাহাব এতেকাফের জন্য যেহেতু সময়ের পরিমাণ নির্ধারিত নেই । তাই তোর কাজাও নেই ।

 

এতেকাফের মাকরুহ

 

১. এতেকাফ অবস্থায় চুপ থাকলে সাওয়াব হয় এই মনে করে চুপ থাকা মাকরূহে তাহরীমী ।

২. বিনা জরুরতে দুনিয়াবী কাজে লিপ্ত হওয়া মাকরূহে তাহরীমী । যেমন ক্রয়-বিক্রয় করা ইত্যাদি । তবে নেহায়েত জরুরত হলে যেমন ঘরে খোরাকি নেই এবং সে ব্যতীত কোন বিশ্বস্ত লোকও নেই । এরূপ অবস্থায় মসজিদে মালপত্র উপস্থিত না করে কেনাবেচার চুক্তি করতে পারে ।

 

 

এতেকাফের স্থান

 

এতেকাফের জন্য সর্বোত্তম মসজিদ নির্বাচন করা । সর্বোত্তম মসজিদ হলো মসজিদুল হারাম । তারপর মসজিদে নববী । তারপর বায়তুল মুকাদ্দাস । তারপর যে জামে মসজিদে জামাতের এন্তেজাম আছে । তারপর মহল্লার মসজিদ । তারপর যে মসজিদের জামাত হয়।

 

এতেকাফের আদব

 

* এতেকাফে বসে নেক কথা ব্যতীত অন্য কথা না বলা ।

 

* বেকার বসে না থেকে নফল নামাজ, তেলাওয়াত, জিকির আযকারে মশগুল থাকা উত্তম ।

 

* এতেকাফে খাস কোন ইবাদত শর্ত করা হয়নি। যে কোন নফল নামায, জিকির ,তেলাওয়াত দীনি কিতাব পড়া বা পড়ানো বা যেগুলো ইবাদাত মনে করতে মনে চায় করতে পারে ।

 

নারীদের এতেকাফ

 

মহিলারা ঘরে এতেকাফ করবে । এজন্য তারা ঘরে নির্দিষ্ট কোন স্থানকে বেছে নিবে ‌। মহিলাদের জন্য মসজিদে এতেকাফ করা জায়েজ নেই । এতেকাফকারী নারীর স্বামী কাছে থাকলে এতেকাফের জন্য তার অনুমতি গ্রহণ করতে হবে । স্বামীর খেদমতের প্রয়োজন থাকলে এতেকাফে বসবে না । শিশু তত্ত্বাবধান ও যুবতী কন্যার প্রতি খেয়াল রাখা প্রয়োজন থাকলে এতেকাফে না বাসায় সমীচীন। মহিলাগণ নির্দিষ্ট কোন কামরা বা ঘরের কোণে এক নির্দিষ্ট স্থানে পর্দা ঘিরে এতেকাফ করবে । মহিলাদের জন্য এতেকাফের অন্যান্য মাসায়েল পুরুষদের মতই ‌।

 

নারীদের এতেকাফ সম্পর্কিত হাদিস

 

১ নং হাদীস

হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করতেন । ইন্তেকাল পর্যন্ত তিনি এই আমল করেছেন । অতঃপর তার সহধর্মিণীগণও রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করতেন ।

( সহীহ বুখারী ও মুসলিম, বুখারী হাদীস নং ২০২৬)

 

২ নং হাদীস

হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহা থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন প্রতি রমজানের কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এতেকাফ করতেন । ফজরের নামাজ শেষ করে তিনি এতেকাফের স্থানে চলে যেতেন । হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা তার নিকট এতেকাফ করার অনুমতি চাইলে তিনি বাড়িতে অনুমতি প্রদান করলেন ।

( সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০৪১)

 

৩ নং হাদীস

 

হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহা থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তার কোনো এক স্ত্রী ইস্তেহাযা অবস্থায় এতেকাফ করেন । তিনি লাল ও হলুদ রঙের স্রাব নির্গত হতে দেখতে পেতেন । অনেক সময় আমরা তার নিচে একটি তস্তরী রেখে দিতাম । (যে রক্ত সেখানেই পরে ) আর তিনি এই অবস্থাতে নামাজ পড়তেন ।

বিশেষ দ্রষ্টব্য:

* হায়েয ও ইস্তেহাযা এক নয় । কেননা ইস্তিহাযা হলো এক প্রকার রোগ । হায়েজ অবস্থায় এতেকাফ করা না গেলেও ইস্তিহাযা অবস্থায় নামায, রোযা, ইতিকাফ সবকিছুই করা যায় । এতে দোষের কিছু নেই ‌। আলোচ্য হাদীস একথার প্রমাণ বহন করে ।

* এতেকাফ অবস্থায় মহিলাদের হায়েজ নেফাস শুরু হলে এতেকাফ ছেড়ে দিবে এবং পরবর্তীতে শুধু ঐ এক দিনের এতেকাফ কাজা করে নিবে । কেননা ইতিকাফ যদিও সুন্নাত কিন্তু সুন্নাত ও নফল জিনিস শুরু করার পর যেহেতু ওয়াজিব হয়ে যায় তাই শুধু ওই এক দিনের এতেকাফ কাযা করতে হবে ।

( আহসানুল ফাতাওয়া, খন্ড ৪ পৃষ্ঠা নং ৫০১)

 

 

এতেকাফের নিয়ত

 

এতেকাফের নির্দিষ্ট কোন নিয়ত নেই । কেন ও কি এতেকাফ করছেন এতোটুকু খেয়াল মনের মধ্যে থাকলেই আদায় হয়ে যাবে । বিষয়টিকে সহজে বোঝার জন্য একটি করে নমুনা দেওয়া হচ্ছে-

 

ওয়াজিব এতেকাফের নিয়ত:

 

আমি ওয়াজিব এতেকাফ আদায়ের জন্য নির্ধারিত দিনের এতেকাফ করছি ।

 

সুন্নাত এতেকাফের নিয়ত :

 

আমি সুন্নাত এতেকাফ আদায়ের জন্য মসজিদে অবস্থান করার নিয়ত করছি ।

 

নফল এতেকাফের নিয়ত:

 

আমি নফল এতেকাফের জন্য মসজিদে প্রবেশ করছি বা নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করছি ।

 

 

এতেকাফের আমল

 

পূর্বেই বলা হয়েছে এতেকাফের জন্য নির্দিষ্ট কোন নিয়ম বা আমল নেই । তবে এ সময়ে এই আমলগুলো করা যেতে পারে ।

১. নামাজ ।‌ অর্থাৎ কাজা নামাজ, নফল নামাজ,শোকরের নামাজ, সালাতুল হাজত, সালাতুর তাসবীহ ,তাহাজ্জুদ , সালাতুত তাওবা ইত্যাদি ।

২. কোরআনুল কারীম তেলাওয়াত । পবিত্র কুরআন নিয়ম করে খতমের চেষ্টা করা ‌। বিশেষ করে সূরা ইয়াসিন, সূরা আর রহমান, সুরা ওয়াকিয়া , সুরা মূলক, সূরা কাহাফ , সুরা হা-মীম সেজদা ,সূরা দুখান‌ পাঠ করা । পবিত্র কুরআন পড়তে না পারলে কারো‌ থেকে শোনা । এটাও সম্ভব না হলে ইখলাস বেশি করে পাঠ করা ।

 

৩. জিকির করা । অর্থাৎ

১. সুবহানাল্লাহ

২. আলহামদুলিল্লাহ

৩. লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ

৪. আল্লাহু আকবার

৫. সুবহানাল্লাহি ওবিহামদিহি

এই জিকিরগুলো বেশি করে পাঠ করা ।

 

৪. ইস্তেগফার । বিভিন্ন রকম ইস্তেগফার আছে।

১. সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার

 

اَللّٰهُمَّ اَنْتَ رَبِّيْ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنْتَ. خَلَقْتَنِيْ وَاَنَا عَبْدُكَ. وَاَنَا عَلٰى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ. اَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ اَبُوْءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ. وَاَبُوْءُ بِذَنْبِيْ فَاغْفِرْ لِيْ فَاِنَّهٗ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ اِلَّاۤ اَنْتَ.

অর্থ: হে আল্লাহ! তুমিই আমার প্রতিপালক, তুমি ব্যতীত অন্য কোন মাবুদ নেই। তুমিই আমার স্রষ্টা এবং আমি তোমার বান্দা। আমি তোমার সাথে কৃত ওয়াদা ও অঙ্গীকারের উপর সাধ্যানুযায়ী অটল ও অবিচল আছি। আমি আমার সকল মন্দ কৃতকর্মের অনিষ্ট হতে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমার প্রতি তোমার অনুগ্রহের কথা স্বীকার করছি এবং আমার গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। সুতরাং তুমি আমাকে ক্ষমা করো কেননা তুমি ছাড়া আর কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারে না। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৩০৬)

 

২.ইস্তিগফার

 

اَسْتَغْفِرُ اللهَ رَبِّيْ مِنْ كُلِّ ذَنْبٍ وَّاَ تُوْبُ اِلَيْهِ.

 

অর্থ: আমি আমার রবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি সর্বপ্রকার গুনাহ থেকে এবং আমি তাঁর নিকট তওবা করছি। (আউনুল মা’বূদ)

 

৩. ইস্তিগফার

 

اَللّٰهُمَّ اغْفِرْلِيْ. وَارْحَمْنـِـيْ. اَسْتَغْفِرُ اللهَ. اَسْتَغْفِرُ اللهَ. اَسْتَغْفِرُ اللهَ

 

অর্থ: হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করো এবং আমার প্রতি দয়া করো। আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাই, আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাই, আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাই।

উল্লেখিত তিনটি ইস্তেগফার ছাড়াও আরো অসংখ্য ইস্তেগফার রয়েছে । যার কাছে যেটা সহজ মনে হয় সেটা বেশি করে পাঠ করা ।‌

 

৫. দরুদ পাঠ করা ।

১.দুরূদে ইবরাহীম

 

اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَلٰى مُحَمَّدٍ. وَّعَلٰى اٰلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلٰى اِبْرَاهِيْمَ وَعَلٰى اٰلِ اِبْرَاهِيْمَ’ اِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ. اَللّٰهُمَّ بَارِكْ عَلٰى مُحَمَّدٍ. وَّعَلٰى اٰلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلٰى اِبْرَاهِيْمَ وَعَلٰى اٰلِ اِبْرَاهِيْمَ. اِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ.

 

অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর বংশধরের প্রতি রহমত নাযিল করো যেমন রহমত নাযিল করেছিলে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও তাঁর বংশধরের প্রতি। নিশ্চয় তুমি প্রশংসনীয় ও মর্যাদাবান। হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর বংশধরের প্রতি বরকত নাযিল করো যেমন বরকত নাযিল করেছিলে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও তাঁর বংশধরের প্রতি। নিশ্চয় তুমি প্রশংসনীয় ও মর্যাদাবান।

 

(সহীহ বুখারী, হাদীস নং৩৩৭০)

 

২. হাদীসের দুরূদ

 

اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَلٰى مُحَمَّدِنِ النَّبِيِّ الْاُمِّيِّ. وَاَزْوَاجِه اُمَّهَاتِ الْمُؤْمِنِيْنَ’ وَذُرِّيَّـــتِه وَاَهْلِ بَيْتِه. كَمَا صَلَّيْتَ عَلٰى اٰلِ اِبْرَاهِيْمَ. اِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ.

অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি রহমত নাযিল করো উম্মী নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর স্ত্রীগণের প্রতি যারা মুমিনগণের মা এবং তাঁর বংশধরগণের প্রতি এবং তাঁর পরিবার পরিজনের প্রতি, যেমন রহমত নাযিল করেছিলে ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম এর পরিবার পরিজনের প্রতি। নিশ্চয় তুমি প্রশংসনীয় ও মর্যাদাবান।

 

(সুনানে আবু দাউদ, হাদীস: ৯৮২)

 

৩. হাদীসের দুরূদ

 

اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَلٰى مُحَمَّدٍ وَّ عَلٰى اٰلِ مُحَمَّدٍ.

 

(সুনানে নাসাঈ, হাদীস: ১২৯২)

 

৪.হাদীসের দুরূদ

 

اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَلٰى مُحَمَّدِنِ النَّبِيِّ الْاُمِّيِّ وَعَلٰى اٰلِ مُحَمَّدٍ.

 

(সুনানে আবু দাউদ হাদীস: ৯৮১/ মুসনাদে আহমাদ, হাদীস: ৪/১১৯)

 

৫. প্রচলিত দরুদ ।

 

اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَلٰى سَيِّدِنَا وَنَبِيِّنَا وَشَفِيْعِنَا وَحَبِيْبِنَا وَمَوْلَانَا مُحَمَّدٍ وَعَلٰى اٰلِه وَاَصْحَابِه وَبَارِكْ وَسَلِّمْ

 

অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সরদার, আমাদের নবী, আমাদের সুপারিশকারী, আমাদের প্রিয় ব্যক্তিত্ব এবং আমাদের মহান নেতা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর, তাঁর পরিবারবর্গ ও তাঁর সাথীবর্গের উপর রহমত, বরকত ও শান্তি বর্ষণ করো।

 

 

টাকা দিয়ে লোক রেখে এতেকাফ করানো

 

আমাদের দেশে অনেক মসজিদে টাকা দিয়ে লোক রেখে এতেকাফ করানো হয় । এভাবে টাকা বা কোন কিছুর বিনিময় গ্রহণ করে এতেকাফ করা কিংবা করানো উভয়টি নাজায়েজ । এ দ্বারা এতেকাফ আদায় হবে না বরং সকলে গোনাহগার হবে ।

( ফাতাওয়ায়ে শামী, খণ্ড নং ২ পৃষ্ঠা নং ১৯৯, ফাতাওয়ায়ে রাহমানিয়া খণ্ড নং ২ পৃষ্ঠা নং ৪৫৮)

 

 

 

লিখেছেনঃ মাওলানা শরিফ আহমাদ

 

Related Articles