ইসলাম

ইফতার করার সঠিক নিয়ম। ইফতার করার দোয়া মাওলানা শরিফ আহমাদ

ইফতার করার সঠিক নিয়ম

 

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ । মাহে রমজানের প্রধান ইবাদাত হলো রোজা রাখা । আর সারাদিন রোজা শেষে অন্যতম আমল হলো ইফতার করা । কিন্তু এই ইফতার করার সঠিক নিয়ম অনেকের জানা নেই । তাই আজ আপনাদের সাথে ইফতার করার সঠিক নিয়ম ও পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ । আমলের নিয়তে লেখাটি পড়তে থাকুন ‌।

 

 

ইফতার কি ও কেন ?

 

ইফতার একটি আরবী শব্দ । শব্দটির অর্থ হলো রোযা ভঙ্গ করা ।

সারাদিন রোজা রাখার পর সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে আযানের পর যে আহার গ্রহণ করা হয় তাকে ইফতার বলা হয় । ইফতার শরীয়তের অনেক বড় একটি আমল।‌ এ আনন্দপূর্ণ আমলের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে বড় বড় পুরস্কার ।

 

 

ইফতার তাড়াতাড়ি করার হাদীস

 

ইফতার যেহেতু অনেক বরকতের তাই এই বরকত পূর্ণ আমল শুরু করতে বিলম্ব করতে নিষেধ করা হয়েছে ।

 

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, লোকেরা যতদিন প্রথম সময় ইফতার করার বিষয়ে যত্নবান হবে ততদিন তারা কল্যাণের পথে থাকবে । ( সহীহ বুখারী , হাদীস নং ১৯৫৭)

 

হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু‌ আলাইহি ওয়াসাল্লাম অথবা ( রাবীর সন্দেহ) আবুল কাশেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা চাঁদ দেখে রোজা আরম্ভ করবে এবং চাঁদ দেখে ইফতার (ঈদ) করবে । তবে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে সাবানের ৩০ দিন পূর্ণ করবে ।

( সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০৯ )

 

ইফতারের মাসায়েল

 

 

* সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর বিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি ইফতার করা মুস্তাহাব । বিলম্বে ইফতার করা মাকরুহ ।

 

* মেঘের দিনে কিছু দেরি করে ইফতার করা ভালো । মেঘের দিনে ঈমানদার ব্যক্তির অন্তরে সূর্য অস্ত গিয়েছে বলে সাক্ষ্য না দেওয়া পর্যন্ত সবর করা ভালো । শুধু ঘড়ি বা আজানের উপর নির্ভর করা ভালো নয় ।‌ কারণ তাতেও ভুল হতে পারে ।‌

রমজানের মাসায়েল

* সূর্য অস্ত যাওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ থাকা পর্যন্ত ইফতার করা দুরস্ত নেই ।

* লবণ দ্বারা ইফতার করা উত্তম এই কথাটি ভুল ।

 

 

হাদীস হিসাবে এই কথাটির জনশ্রুতি রয়েছে ‌– আহারের শুরু ও শেষ লবণ দিয়ে করা । কারণ লবণ ৭০ টি রোগের ঔষধ যথা পাগলামি ,কুষ্ঠ ও শ্বেত ইত্যাদি । কিন্তু বাস্তবে তা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস নয় । এটি একটি জাল বর্ণনা । ইমাম বাইহাকী , ইবনুল জাওযী ,ইবনুল কাইয়ুম হাফেজ সুয়ূতী এবং আল্লামা আররাক রহঃ মুহাদ্দিসীনে কেরাম একে জাল বলে আখ্যা দিয়েছেন ।

 

 

স্মরণ রাখবেন , চিকিৎসাবিজ্ঞানেও আলাদা লবন খাওয়া ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হয়েছে । ডাক্তারগণ নিষেধ করে থাকেন । তাই লবণ দ্বারা ইফতার করা থেকে বিরত থাকুন ।‌

 

ইফতার করার সঠিক নিয়ম 

 

সুন্নাতী ইফতার কি ?

 

 

ইফতার খেজুর দ্বারা করা মুস্তাহাব । খেজুর না পেলে পানি দ্বারা ইফতার করা যাবে । এ সম্পর্কে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের ঘোষণা- যে ব্যক্তি খেজুর পাবে সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে। যে ব্যক্তি খেজুর পাবে না সে পানি দ্বারা ইফতার করলেও চলবে । কারন পানিও পবিত্র । ( সুনানে নাসায়ী )

 

 

হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাগরিবের নামাজ পড়ার আগে তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তাজা খেজুর না পেলে শুকনা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। আর তাও না পেলে এক ঢোক পানি দ্বারা ইফতার করতেন।(জামে তিরমিযী , হাদীস নং ৬৯২)

 

 

রোজা রাখার পর স্বাভাবিক কারণেই কিছুটা শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয়। এ কারণে এমন জিনিস দ্বারা ইফতার করতে হবে যা সহজে হজম হবে এবং শরীরে শক্তি যোগাবে । আর এক্ষেত্রে খেজুর হচ্ছে পারফেক্ট খাদ্য ।

 

খেজুরের রাসায়নিক গুনাগুন

 

এক. প্রোটিন ২.০ দুই. ফ্যাট ২.০ তিন. কার্বো হাইড্রেটস ২৪.০ চার. ক্যালোরী ২.০ পাঁচ. সোডিয়াম ৪.৭ ছয়. পটাশিয়াম ৭৫৪.০ সাত. ক্যালসিয়াম ৬৭. ৯ আট. ম্যাগনেমিয়াম ৫৮. ৯ নয়. কপার ০.২১ দশ. আয়রণ ১.৬১ এগারো. ফসফরাস ৬৩৮. ০ বারো. সালফার ৫১.৬ তেরো. ক্লোরাইন ২৯০.০

এ ছাড়া খেজুরের মধ্যে প্যারোক্সাইডেস ও পাওয়া যায়। রোজার সময়ে ভোর রাতে সাহরী খাওয়ার পর সন্ধ্যা পর্যন্ত কিছু পানাহার করা যায় না । এ কারণে দেহে‌ ক্যালোরি এবং উত্তম ক্রমাগত কমতে থাকে ।‌ তাই খেজুর দিয়ে ইফতার করলে দেহের ক্যালোরি এবং উত্তাপে ভারসাম্য ফিরে আসে ।‌ দেহ নানা প্রকার রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারে । তাই রোজাদারদের জন্য খেজুর হচ্ছে আদর্শ খাদ্য ।

 

ইফতারে স্বাস্থ্যকর খাবার

 

ইফতার বা সাহরীতে প্রোটিন জাতীয় খাবার যেমন মাংস, মাছ, ডিম ও ভাজা পোড়া অর্থাৎ পিয়াজু ,আলুর চপ, বেগুনি ইত্যাদি কম খাবেন। সারাদিন রোজা রেখে এসব খাবার গ্যাস্ট্রিকের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।

আর হ্যাঁ মনে রাখবেন , প্রোটিন জাতীয় খাবার পানির তৃষ্ণা বাড়ায়। আর পানির তৃষ্ণা বৃদ্ধি পেলে সারাদিন রোজা রাখতে অনেক কষ্ট হবে ।‌ ইফতারির প্লেটে এই আইটেমগুলো রাখতে পারেন-

১. সালাদ ২.খেজুর ৩. ফল-ফলাদি ৪.ছোলা ৫.পানি ।

এই ধরনের হালকা কিছু দিয়ে ইফতার করুন।‌

 

 

 

ইফতারে প্যাকেটজাত জুস বা বিভিন্ন ব্রান্ডের তৈরি ইফতারের পরিবর্তে দেশীয় মৌসুমী ফল খান। দেশীয় নিয়মে শরবত তৈরি করুন । এটা উত্তম হবে ।

 

 

ইফতার করানোর ফজিলত

 

ইফতার করানো একটি সাওয়াব ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম। ‌ইফতার করানোর ফজিলত সম্পর্কে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি এ মাসে রোজাদারকে ইফতার করাবে তা‌ তার পাপমোচন ও দোযখ থেকে মুক্তির কারণ হবে এবং এতে সে ওই রোজাদারের সম্মান পুণ্যের অধিকারী হবে । অথচ রোজাদারের পুণ্য তাতে একটুও কমবে না ।

 

 

তখন সাহাবীগণ আরজ করলেন ইয়া রাসুলুল্লাহ ! আমাদের সকলের তো রোজাদারকে (তৃপ্তি সহকারে) ইফতার করার সামর্থ্য নেই । তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে এক ঢোক দুধ দ্বারা বা একটি খেজুর দ্বারা বা একটু পানি দ্বারা ইফতার করাবে তাকেও আল্লাহ তাআলা রোজাদারের সমান সওয়াব দিবেন।

 

পড়ুন –

#রমজানে করনীয় বর্জনীয়

# সেহরি ইফতারের সময়সূচি জানুন 

 

 

আর যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে তৃপ্তি সহকারে উদর পূর্ণ করে খাওয়াবে আল্লাহ তাআলা তাঁকে আমার হাউস থেকে এমন পানি পান করাবেন যে সে জান্নাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আর কখনো পিপাসার্ত হবে না ।

( সহীহ ইবনে খুযাইমা )

 

 

হযরত যায়েদ ইবনে খালেদ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে সে তার অনুরুপ প্রতিদান লাভ করবে । তবে তার প্রতিদান থেকে বিন্দুমাত্র কম করা হবে না ।‌ (সুনানে তিরমিযী ,হাদীস নং ৮০৭)

 

 

সুতরাং নিজেদের ইফতার করার পাশাপাশি অপর রোজাদারকে ইফতার করানোর একটা বাজেট নির্ধারণ করা উচিত । এবং একাজে প্রতিযোগিতা করে একে অপরের আগে যাওয়ার চেষ্টা করা দরকার। কেননা নেক কাজে প্রতিযোগিতা করা কেবল জায়েজ নয় বরং আল্লাহর হুকুম এবং নবীজির ঘোষণা ।

 

ইফতারের আগের আমল

 

ইফতারের আগ মুহূর্তে দুআ করা যায়। কেননা এ সময় দোয়া কবুল হয় ।

রোজার মাধ্যমে মুমিন বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে যতক্ষণ সে রোজা অবস্থায় অথবা রোজার প্রস্তুতি অবস্থায় থাকে।‌ তখন তার কোন দুআ ফেরত দেওয়া হয় না । সমস্ত দোয়া কবুল করা হয় । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন প্রত্যেক মুসলিমের রমজানের দোয়া করে তা কবুল করা হয় ।(মুসনাদে বায্যার , ৩১৪১)

 

 

আব্দুল্লাহ ইবনে মুলাইকা রহ: বলেন, আমি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমরকে ইফতারের সময় এ দুআ করতে শুনেছি, আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা বি রাহমাতিকা আল্লাতি ওসিআত কুল্লা শায়ইন আন তাগফিরলি’। অর্থাৎ, হে আল্লাহ, আমি তোমার দরবারে সেই রহমতের উসিলায় আবেদন করছি যা সকল বস্তুকে বেষ্টন করে রেখেছে, তুমি আমাকে মাফ করে দাও। (মুসতাদরাকে হাকেম , ১/৫২৯, হাদীস নং ১৫৬৭) অতএব দুআর প্রতি সকলের আরও গুরুত্ব বাড়ানো উচিত ‌।

 

ইফতার করার দোয়া

 

ইফতারের দোয়া

ইফতার করার আগে বেশি বেশি দোয়া পাঠ করুন ।

يَا وَاسِعَ الْمَغْفِرَةِ اغْفِرْ لِي

 

বাংলা উচ্চারণঃ ইয়া ওয়াসিআল মাগফিরাহ! ইগফিরলী…। (শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৩৬২০)

অন্যান্য হাদীসের কিতাবে এই দোয়াটি পড়ার কথা বর্ণিত হয়েছে-

।‌

يا واسع الفضل اغفرلي

বাংলা উচ্চারণ: ইয়া ওয়াসি আল ফাদলি ইগফিরলি ।

 

ইফতার করার সময়ের দোয়া

‌ للَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ، وَعَلَى رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ (১)

অথবা

اللهم لك صمت وعلى رزقك افطرت برحمتك يا ارحم الراحمين .(২)

বাংলা উচ্চারণ:

( ১) আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়ালা রিজকিকা আফতারতু ।‌

(২) আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়ালা রিজকিকা আফতারতু বিরাহমাতিকা ইয়া আর হামার রাহিমীন । ( সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২৩৫৮, মুজামুল আওসাত, হাদীস নং-৭৫৪৯)

বাংলা অনুবাদঃ হে করুনাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ আমি তোমারে সন্তুষ্টির জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমার দেওয়া রিযিক এর মাধ্যমে ইফতার করছি ।

 

ইফতার শেষের দোয়া

 

ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوقُ، وَثَبَتَ الْأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللَّهُ

 

বাংলা উচ্চারণ: জাযাহাবাজ জামাউ ওয়াবতাল্লাতিল উরুক্বু, ওয়াছাবাতাল আজরু ইনশাআল্লাহু। (আবু দাউদ, হাদীস নং-২৩৫৭)

 

 

শেষকথাঃ

 

প্রিয় পাঠক । জীবনঘনিষ্ঠ যেকোন প্রশ্ন উত্তর জানতে কমেন্টে দেখুন । দ্রুত জবাব দেওয়া হবে ইনশাআল্লাহ । ভালো থাকুন । সুস্থ ও সুন্দর থাকুন ‌।‌ দৈনিক শিক্ষা নিউজের সঙ্গে থাকুন । আজ এ পর্যন্তই । আল্লাহ হাফেজ ।

 

লিখনে: মাওলানা শরিফ আহমাদ

ঢাকা, বাংলাদেশ ।

 

 

Related Articles